সীমানাপ্রাচীর দেওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দ্বিতল স্কুল ভবন। ছোট্ট খেলার মাঠ। কিন্তু শিশুদের ওই ছোট্ট খেলার মাঠটিই দখল করে স্থাপন করা হয়েছে ১০টি দোকান। প্রতিদিন দুপুর গড়াতেই স্কুলমাঠে বসে অস্থায়ী আরও ২০টি দোকান। হাটের দিন এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। স্কুল চলাকালে এসব দোকানে থাকে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পান্ডুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এমনই।
স্কুলমাঠ দখল করে দোকান ও বাজার বসার কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মুক্তভাবে খেলতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিলেও প্রভাবশালীদের চাপে এক বছরেও তা আলোর মুখ দেখেনি। স্কুলটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক মাহমুদুল হক জানান, স্কুলের মাঠ দখল করে এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে অবহিত করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও শিক্ষা অফিসে অভিযোগ করলেও এক বছরেও এর কোনও সমাধান হয়নি। এজন্য তারা আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, স্কুলের প্রবেশপথে ব্রয়লার মুরগির দোকান। সীমানা প্রাচীরের ভেতর স্কুলমাঠে কাঁচা বাজারের দোকান খুলে বেচাকেনায় ব্যস্ত দোকানিরা। রয়েছে চানাচুরের দোকান, চায়ের দোকানসহ কমপক্ষে ১০টি স্থায়ী দোকান। স্কুল চলাকালে বেচাকেনাও চলছে। এসব দোকান ও কাচামাল ব্যবসার কারণে বিরতির সময় স্কুলমাঠে শিক্ষার্থীরা মুক্ত পরিবেশে খেলাধুলা করতে পারছে না। শিশুদের খেলার সামগ্রী মাঠে স্থাপন করতে না পেরে এক কোণে ফেলে রাখা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা জানায়, স্কুলমাঠে সব সময় দোকান থাকে। তারা স্কুলে না বাজারে আছে সেটা বোঝা দায়। ক্লাস চলার সময়ে দোকানে বেচাকেনা চলে। বিরতির সময় খেলতে গেলে দোকানদাররা বকঝকা শুরু করেন।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিম আক্তার রেশমা বলে, ‘আমাদের স্কুলমাঠে অনেক দোকান। প্রতিদিন ক্লাস ও খেলার সময় আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। মাঠে দোকান থাকবে কেন? স্যাররা বলেও কোনও কাজ হয় না। এই দোকানগুলো বন্ধ করা দরকার।’
শেখ ফরিদ নামে পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী বলে, ‘মাঠে দোকানদার ও ক্রেতাদের চিল্লচিল্লিতে আমরা ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। খেলতে গেলেও সমস্যা। স্কুলমাঠ থেকে এসব দোকান সরানো দরকার। কিন্তু কে সরাবে!’ দোকানগুলো সরবে কিনা সে প্রশ্ন রাখে এই শিক্ষার্থী।
স্কুলের পাশের বাসিন্দা বাবলু বলেন, ‘এই স্কুলের মাঠটা এমনিতেই ছোট। মাঠের ভেতর অনেক দোকান। এখানে সবজি বিক্রি হয়, স্কুলের জায়গা দখল করে কাঁচামালের দোকান বসানো হয়েছে। মাঠে বাঁশও বিক্রি হয়। আমরা বারবার চেষ্টা করেও এই দোকানগুলো উচ্ছেদ করতে পারিনি। আমরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
বিদ্যালয়ের মাঠে দোকান বসানো নিয়ে দোকানি সুরুজ মিয়া বলেন, ‘এই স্কুলে আমার তিনটা বাচ্চা পড়ে। তাদের সমস্যা হয় সেটা বুঝি। বাজার কমিটির আমাদের এখানে বসিয়েছে। আমরা বাজার কমিটিকে দৈনিক ১৫ টাকা খাজনা দিয়ে ব্যবসা করি। আমরা এখানে বসতে চাই নাই। আমাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে দিলে ভালো হয়।’
প্রধান শিক্ষক মাহমুদুল হক বলেন, ‘একবছর আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ইউএনও বরাবর অভিযোগ করেছিলাম। কোনও কাজ হয়নি। এর আগে স্কুলের দুটি পকেট গেটসহ দোকানগুলো উচ্ছেদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিই। কিন্তু নানা চাপের কারণে উচ্ছেদ করতে পারিনি।’
পান্ডুল বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও হাট ইজারাদার মনতাজ আলী বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এভাবে স্কুলমাঠে দোকান চলছে। আমরা হাট ইজারা নিয়ে চালাই– এটি ইউএনও, এসিল্যান্ড ও তহশিলদার জানেন। তারা অনেকবার দেখেও গেছেন।’
স্কুলমাঠে দোকান বাসিয়ে হাট-বাজার চালানো আইনসিদ্ধ কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্কুলও সরকারি, হাটও সরকারি। প্রশাসন সরাতে বললে আমরা সরিয়ে নেবো।’
উপজেলা শিক্ষা অফিসার আমির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। সরকারি নির্দেশনা মতে, স্কুলের কোনও জমি দখল হয়ে থাকলে তা উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রশাসনের সহায়তা চাইবো।’
উপজেলা সহকারী কমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘স্কুল মাঠে হাট-বাজার বসানোর কোনও সুযোগ নেই।’
তবে উচ্ছেদ প্রশ্নে তিনি খানিকটা দায়সারা জবাব দেন। বলেন, ‘লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ যদিও প্রধান শিক্ষকের দাবি, এক বছর আগে লিখিত অভিযোগ দিয়ে দোকান উচ্ছেদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।