ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের চরকালীবাড়ি আবাসিক এলাকায় ফসলি জমিতে গড়ে তোলা সিসা তৈরির কারখানা। এখান থেকে নির্গত ধোঁয়া, ক্ষতিকর ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন কয়েক এলাকার লক্ষাধিক মানুষজন।
চিকিৎসকরা বলছেন, ব্যাটারির বর্জ্য পুড়িয়ে সিসা তৈরি করলে তা আশপাশে থাকা মানুষের শরীরে পয়জনিং (রক্তকণিকা ও মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতি করা) সৃষ্টি করে। ফলে মানসিক বিকৃতি, রক্তশূন্যতা ও মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন হতে পারে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানার ভেতরে শ্রমিকরা পুরোনো ব্যাটারির ওপরের অংশ খুলে প্লেট (ব্যাটারির ভেতরে থাকা পাত) বের করছেন। পরে ব্যাটারি থেকে অ্যাসিড বের করে সংরক্ষণ করছেন। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুল্লির মধ্যে কাঠ ও কয়লায় অ্যাসিড মিশ্রিত ব্যাটারির বর্জ্য বা প্লেট সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিলে তা গলতে থাকে। একইসঙ্গে বৈদ্যুতিক পাখা থেকে বাতাস দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সিসা তৈরি হয়। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন তারাও।
চরকালীবাড়ি এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এলাকার মানুষ। ঝরে পড়ছে গাছের পাতা, ফল, নারকেল ও আম-জাম। কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য কৃষিজমিতে পড়ায় কমেছে ফসল উৎপাদন। খাল ও ডোবায় মারা যাচ্ছে মাছ। ঘাস খেয়ে মারা গেছে গবাদিপশু। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, নগরীর ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের চরকালীবাড়ি আবাসিক এলাকার চায়না মোড়ে ‘মন্ডল করপোরেশন’ নামে সিসা তৈরির কারখানা তৈরি করা হয়েছে। কারখানা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ। এতে চরকালীবাড়ি, চরঝাউগড়া, চরগোবদিয়া, চরঈশ্বরদিয়া, শম্ভুগঞ্জ বাজার ও রঘুরামপুরসহ আশপাশের কয়েক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষজন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। তবু কারখানা বন্ধের উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।
ক্ষোভ প্রকাশ করে চরকালীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারখানা চালুর পর থেকে দুর্গন্ধ ও ধোঁয়ার কারণে বাসার দরজা-জানালা খোলা যায় না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এলাকার অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত এমন নানা অসুখ-বিসুখের সঙ্গে লড়াই করতে হয় আমাদের। এরপরও কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতর।’
চরঝাউগড়া গ্রামের কৃষক গোলাম কুদ্দুস অভিযোগ করে বলেন, ‘কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য এসে পড়ছে আশপাশের কৃষিজমি ও মাঠে। সেখানের ঘাস খেয়ে অনেকের গবাদিপশু অসুস্থ হয়েছে। গত তিন বছরে আশপাশের এলাকার কৃষকদের অন্তত ২০টি গরু মারা গেছে। এ নিয়ে অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি।’
শম্ভুগঞ্জ বাজার এলাকার বাসিন্দা ও শম্ভুগঞ্জ ইউ সি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইসমাইল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের এলাকার গাছের নারকেল, আম-জাম, কাঁঠাল ও নানা ফল টিকছে না। গাছের পাতা পর্যন্ত ঝরে পড়ছে। কারখানার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া পাইপ দিয়ে ওপরের দিকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্জ্য ফেলা হচ্ছে আশপাশের ডোবায় এবং ফসলি জমিতে। এতে কৃষি উৎপাদন আগের অনেক তুলনায় কমেছে।’
ফসলি জমিতে সিসা তৈরির কারখানা গড়তে পরিবেশ অধিদফতর অনুমোদন দিয়েছিল কিনা জানতে চাইলে মন্ডল করপোরেশনের মালিক মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং পরিবেশ অধিদফতরের চাহিদার সব কাগজপত্র জমা দিয়ে অনুমোদন নিয়েই কারখানা পরিচালনা করছি। কারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্যে কারও ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে হয় না।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর ময়মনসিংহ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মেজ-বাবুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালি জায়গা ও কোনও বসতি নেই—সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের এমন ছাড়পত্র পেয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে সিসা তৈরির কারখানার অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।’
বাস্তবে ওই কারখানার আশপাশে কৃষিজমি ও বসতি আছে এমনটি জানালে উপপরিচালক বলেন, ‘তাহলে যেখানে আলাদা শিল্পজোন নেই, সেখানে কারখানা কোথায় হবে?’ উল্টো প্রশ্ন রাখেন তিনি।
কারখানাটি পরিবেশ অধিদফতরের শর্ত মেনে চলছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মেজ-বাবুল আলম বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’
তবে সিসা কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বলে উল্লেখ করেছেন ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সিসা কারখানার ধোঁয়া ও বিষাক্ত রাসায়নিকে মানুষের শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এমন ধোঁয়া ও বর্জ্য থেকে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ফলে এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের সতর্ক হতে হবে।’