ফসল হারিয়ে পাঁচ শতাধিক কৃষক নিঃস্ব, দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন
বাংলাদেশ

ফসল হারিয়ে পাঁচ শতাধিক কৃষক নিঃস্ব, দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামটি গ্রাফটিং পদ্ধতিতে টমেটো চাষের জন্য সবার কাছে পরিচিত। গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে পলিথিনের বেড়ার নিচে স্তূপ করে রাখা বন্যায় বিনষ্ট টমেটোর চারা। চারদিকে শুধু ক্ষতির চিহ্ন। চাষিরা নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন। 

কথা হয় বনগাঁও গ্রামের টমেটো চাষি রোমেনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‌‘স্বামীসহ পাঁচ সদস্যের সংসার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। এতদিন টমেটোর চারা বিক্রি করে সংসার চলছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে সেই স্বপ্ন শেষ। সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে টমেটো গাছ লাগিয়েছিলাম। বন্যা সব নিয়ে গেছে।’ তার মতো একই অবস্থা গ্রামটির শতাধিক চাষির। বন্যার পানিতে ফসল হারিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটছে দিন।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে কমলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের চার শতাধিক চাষি ২০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। বন্যায় নষ্ট হয়েছে ১২ হেক্টর জমির ফসল। ক্ষতির হার ৫৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রাফটিং পদ্ধতিতে লাগানো টমেটোর চারা।

একই উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের আট গ্রামের শতাধিক চাষি গ্রাফটিং পদ্ধতিতে লাগানো টমেটোর চারা বিক্রি করে সংসার চালান। আবার চাষও করেন। উৎপাদিত টমেটো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হয়। কিন্তু সম্প্রতি বন্যায় উপজেলার ১০ গ্রামের ৩৫৪ চাষির প্রায় ৩২ লাখ টমেটোর চারা মাঠে নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক চাষির ক্ষতির পরিমাণ ছয় কোটি টাকা বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

সরেজিমনে আদমপুর ও ইসলামপুরের মকাবিল, কোনাগাঁও, বনগাঁও গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, টমেটোর মাঠ ফাঁকা। চারদিকে পানি জমে আছে। পানিতে চারাগুলোর পলিথিনের ভেতরের মাটি সরে গেছে। অনেক জমি পলিমাটিতে সারিবদ্ধ গ্রাফটিং টমেটোর জন্য তৈরিকৃত ঘর ভরাট হয়ে পড়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন, সংসার চালাবেন; তা জানেন না অনেকে।

চাষিরা জানিয়েছেন, স্থানীয় কৃষি বিভাগের হিসাবের চেয়ে তাদের ক্ষতির পরিমাণ বাস্তবে অনেক বেশি। অন্তত ৪০ লাখ টমেটোর চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি মাঠের ৫ হেক্টর জমির চারা নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রাফটিং পদ্ধতির প্রতিটি চারা বিক্রি হয় আট টাকায়। এই হিসাবে চার কোটি টাকার চারা এবং মাঠে রোপণকৃত  যে টমেটোর ক্ষেত নষ্ট হয়েছে, তার বাজার মূল্য তিন কোটি। প্রতি কেজি টমেটো পাইকারি দামে ৭০-৮০ টাকা এবং খুচরা ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়। একটি গাছে গড়ে ছয়-সাত কেজি ফলন হয়।

স্থানীয় কৃষি গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, বনগাঁও গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হয় গ্রাফটিং টমেটোর চারা।  নার্সারি করে চারা উৎপাদন ও টমেটো চাষ গ্রামের মানুষের আয়ের বড় উৎস। বনগাঁওয়ের মতো উপজেলার অনেক গ্রামে বেগুনের চারার সঙ্গে টমেটোর গ্রাফটিং চাষ হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। টমেটো চাষে অনেকের ভাগ্য বদলে গেছে। এ বছর ব্যাপক হারে চারা উৎপাদন ও ফলন হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বন্যায় তাদের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। শত শত চাষি নিঃস্ব হয়েছেন। ক্ষতি পুষিয়ে মাঠে ফেরার আর্থিক অবস্থা নেই কারও। বিভিন্ন এনজিও ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে করা টমেটো চাষ হারিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা।

বনগাঁও গ্রামের কৃষক রাশিদ মিয়া ও খালিক মিয়া জানিয়েছেন, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমিতে ধারদেনা করে টমেটো চাষ করেছেন তারা। বন্যায় সব শেষ করে দিয়েছে। এখন নিঃস্ব অবস্থায় আছেন তারা।  

একই গ্রামের জাবের মিয়া ও ছাদ উদ্দিন জানিয়েছেন, ১২০ শতাংশ জমির টমেটো চারা পচে গেছে তাদের। এই টমেটো চাষ করে সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। এখন কীভাবে ঋণ পরিশোধ ও সংসার চালাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন দুজনেই।

ইসলামপুরের কৃষক মোখলেছ মিয়া বলেন, ‘গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে এ ধরনের বন্যা দেখিনি। এবারের বন্যায় জমির সব ফসল ভেসে গেছে। অনেকের ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। আমাদের এলাকার মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই বন্যায় আমাদের বড় ধরনের লোকসান হয়েছে। আমার ৪০ হাজার চারা নষ্ট হয়েছে। এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ হবে না।’

একই এলাকার চাষি রোশন মিয়া বলেন, ‘আমার ১৫০ শতাংশ জমিতে টমেটো আর নার্সারির ৪০ হাজার চারা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কোনও টাকাও নেই যে, তা দিয়ে আবার চাষাবাদ করবো।’

ওমর মিয়া বলেন, ‘আড়াই লাখ টাকা খরচ করে টমেটোর নার্সারি করেছি। যাদের কাছে চারা বিক্রি করি, তাদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছিলাম। বন্যায় সব ডুবে গেছে। আশা ছিল, ১৫ লাখ টাকার চারা বিক্রি করতে পারবো। কিন্তু এখন মাঠ ফাঁকা। কীভাবে দেনা পরিশোধ করবো আর সংসার চালাবো তা নিয়ে চিন্তায় আছি।’

স্থানীয় কীটনাশক ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এবার বাকিতে টমেটো চাষিদের কাছে প্রায় ৩০ লাখ টাকার কীটনাশক বিক্রি করেছি। কিন্তু বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় সেসব কৃষক এখন নিঃস্ব। কৃষকের কাছে কীভাবে পাওনা চাইবো কিংবা তারা কীভাবে পরিশোধ করবেন কোনও উপায় দেখছি না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য আমি সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। না হয় আমরা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাবো।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের তথ্যমতে কমলগঞ্জ উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। শুধু চাষি নন, টমেটো খামারে খণ্ডকালীন কর্মসংস্থান হয়েছিল কয়েকশ মানুষের। বন্যায় ফসল হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন সবাই। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে প্রণোদনা ও কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবো আমরা।’

Source link

Related posts

তাড়াশে ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী দই মেলা শুরু

News Desk

উদযাপন যেন সংক্রমণ বাড়ার উপলক্ষ না হয়, আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

News Desk

‘ছেলের লাশটা হলেও দিন’

News Desk

Leave a Comment