চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থেকে মিরসরাই উপজেলা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেঁষে ৬০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তুলতে চায় চীন। গত বছরের নভেম্বর মাসে চীন এ সংক্রান্ত একটি রূপরেখা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে জমা দেয়। ওই দেশের চারটি রাষ্ট্রয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে প্রকল্প এলাকার স্থানীয়রা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তাবায়ন করতে গেলে সাগরের পাশ ঘেঁষে ঠাঁই নেওয়া কয়েক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে সাগরের জমি উদ্ধার করে সরকারি জমিতে। এখানে ব্যক্তি মালিকানা কোনও জমি থাকবে না। এরপরও কোনও বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা।’
সিডিএ’র প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘স্মার্ট সিটি প্রকল্পটি নির্মাণাধীন বে-টার্মিনালের পর থেকে শুরু হয়ে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন পর্যন্ত চারটি ধাপে যাবে। এ প্রকল্পে তীরে কোনও জমি ব্যবহার করা হবে না। দেড় থেকে তিন কিলোমিটার প্রস্থের এবং ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গোপসাগরের পাশ ভরাট করে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে নতুন করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার একর জমি সাগর থেকে চট্টগ্রামে যোগ হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে দুই লাখ মানুষের। উন্নয়নের ছোঁয়া লাগবে আরও ১১০ কিলোমিটার এলাকায়। স্মার্ট সিটি প্রকল্প করে দিতে চীন নিজ থেকে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি এ প্রকল্প পেলে চট্টগ্রামে মেট্রোরেলও করে দেবে চীন। এক্ষেত্রে সরকারকে কোনও অর্থ দিতে হবে না। স্মার্ট সিটির প্লট-ফ্ল্যাট থেকে মেট্রোরেলে খরচের টাকা তুলে নেবে।’
তবে স্মার্ট সিটি নিয়ে সাবধানে এগোতে ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাস বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘সিটি যেটা আছে সেটাই সঠিকভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না, আবার স্মার্ট সিটি বানাবে। এসব বলে জনগণকে বোকা বানানো ছাড়া আর কিছুই হবে না। চীন প্রস্তুাব দিয়েছে, মনে রাখতে হবে তারা ব্যবসায়ী। ঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে। তা না হলে বিপদ আছে।’
অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, ‘পতেঙ্গায় সিটি আউটার রিং রোডের পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ‘স্মার্ট সিটি’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমাদের এলাকাবাসীর কোনও সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে আউটার রিং রোডের পাশ ঘেঁষে বসবাসকারী বেশ কিছু ভাসমান মানুষ আশ্রয় হারাবে। এরমধ্যে আমার ওয়ার্ডে আছে অন্তত দুই হাজার পরিবার। পুরো সিটি আউটার রিং রোডের পশ্চিম পাশে সাগরের পাশ ঘেষে অন্তত ৫-৭ হাজার পরিবার আছে। মিরসরাই পর্যন্ত গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভাসমান পরিবারের সংখ্যা আরও বাড়বে। সরকার নিশ্চয়ই এসব পরিবারগুলোকে যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।’
চসিকের ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘পতেঙ্গার দরিদ্র মানুষের স্মার্ট সিটির চেয়ে বেশি প্রয়োজন ইকোনমিক জোন। কল-কারখানা হলে এখানকার মানুষ চাকরি পেতো। এটাই ভালো হতো।’
এদিকে সিডিএকে দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, সাগরের জমি উদ্ধার করে যে ‘স্মার্ট সিটি’ তারা গড়তে চায়, তার দায়িত্ব তাদের হাতেই থাকবে। সেখানে প্লট বিক্রির টাকা তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে। বে-টার্মিনালের পর থেকে মীরসরাই পর্যন্ত অংশের সাগরের জমি উদ্ধারের কথা রয়েছে প্রস্তাবে। তবে মাঝে জাহাজভাঙা শিল্পসহ যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলো বাদ যাবে। সাগর থেকে বালু তুলে স্মার্ট সিটির জমি তৈরি করা হবে। এজন্য আলাদা করে কোনও ভূমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হবে না। এ প্রকল্পের বিনিময়ে চায়না প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম নগরীতে মেট্রোরেল করে দিতে চায়। মেট্রোরেল যাবে প্রকল্পের সামনে দিয়ে মিরসরাই ইকোনমিক জোন পর্যন্ত। অপরদিকে হাটহাজারী, রাউজান, বোয়ালখালী এবং পটিয়া উপজেলাকেও মেট্রোরেলের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
সিডিএ বলছে, স্মার্ট সিটি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে অন্তত দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এই প্রকল্প ১ দশমিক ১ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস্ বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের নাম দিয়েছে ‘সি-সাইড বে ভিউ স্মার্ট সিটি’। এই ‘স্মার্ট সিটি’ গড়ে তোলার বিনিময়ে চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের একটি জোট চট্টগ্রামে মেট্টোরেল করে দেবে নিজেদের খরচেই। মেট্টোরেলের টাকা তারা প্রস্তাবিত ‘স্মার্ট সিটি’ থেকে পুষিয়ে নেবে। শিগগিরই স্মার্ট সিটির প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে এ প্রকল্প বাস্তাবায়নে পরবর্তী ধাপগুলো অতিক্রম করবে।
তিনি আরও বলেন, চীন, সিঙ্গাপুর ও মালেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্মার্ট সিটির আদলে চট্টগ্রামের এ স্মার্ট সিটি হবে। এ সিটি নির্মাণে সরকার থেকে কোনও অর্থ দিতে হবে না। বরং এ প্রকল্পের লাভের টাকা দিয়ে প্রস্তুতকারী সংস্থা নগরীতে মেট্রোরেল করে দেবে। এ সিটিতে ফ্ল্যাট, প্লট, হোটেলসহ বিনোদনের জন্য যা প্রয়োজন সবই থাকবে বলে জানান তিনি।