ঘরের কাঠ ভেঙে গেছে। টিনে মরচে ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ। বৃষ্টি হলে প্রতি ঘরে পানি পড়ে। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে চালার ওপর খড়কুটো ও পলিথিন দেওয়া হয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর ভাঙা ঘরে বসবাস করছে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার আব্দুলপুর ইউনিয়নের চিরিরবন্দর রেলওয়ে সেতু আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩০টি পরিবার।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা গৃহবধূ সারজিনা আক্তার বলেন, ‘সরকার ঘর দিছে একটা, হামরা মানুষ সাত জন। কেউ চালিত থাকি, কেউ ঝুপড়ি বানাইয়া থাকি, আবার কেউ ঘরত থাকি। টিন দিয়া পানি পড়ে, সমস্যা অনেক। এভাবে আছি। সরকার যদি নতুন ঘর দিতো খুব ভালো হতো।’
একই প্রকল্পের ঘরের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, ‘একটা ঘরে পাঁচ জনের বসবাস। দুইটা নাতি বড় হইছে। ছেলে, ছেলের বউ এবং দুই নাতি নিয়ে থাকি। এমন একটা ঘরত কেমন করি থাকি। সেই ঘর দিয়াও আবার পানি পড়ে। বারান্দায় ঝুপড়ি বানাইয়া থাকি। সবার সমস্যা হয় শীতে, হামার সমস্যা বর্ষায়। টিন দিয়া পানি পড়ে, অল্পতেই পানি উঠি যায়। কাপড়-চোপড় নিয়ে উঁচু জায়গাত চলি যাই। আমি মানুষের বাসাত কাজ করি। মাসে তিন হাজার টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে সংসার চলে পাঁচ জনের।’
প্রকল্পের বাসিন্দা শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘ঘরের টিন, কাঠ ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানি পড়ে। নতুন ঘর করে দেবে বলেছে। কিন্তু এখনও দেয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিরিরবন্দর রেলওয়ে সেতু আশ্রয়ণ প্রকল্পে পদবানু, সখিনা ও জমিলা খাতুনসহ ৩০ পরিবারের সবার অবস্থা একই। ২৩ বছর ধরে প্রকল্পের ঘর সংস্কার না করায় বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে সরকারি অর্থায়নে আব্দুলপুর ইউনিয়নের চিরিরবন্দর গ্রামে দুই একর ৮৫ শতক খাস জমিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩০ পরিবারের জন্য তিনটি ব্যারাক নির্মাণ করা হয়। প্রতি ঘরে ১০টি করে ঘর রয়েছে। প্রতিটি ঘরের জন্য চার শতাংশ করে জমি দেওয়া হয়। ১০টি পরিবারের জন্য যৌথভাবে চারটি শৌচাগার, দুটি গোসলখানা ও একটি নলকূপ দেওয়া হয়।
কিন্তু ২৩ বছরেও সংস্কার না হওয়ায় এসব ঘরের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ। ঘরের টিনে মরচে ধরেছে, ছিদ্র হয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছে। শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে নলকূপও। ভেঙে গেছে ঘরের দরজা-জানালা।
বেশিরভাগ টিন আলাদা হয়ে গেছে। ভেঙে যাওয়া দরজা-জানালা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন সবাই। পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা বাড়লেও সুবিধা এবং জায়গা বাড়েনি। দিনে দিনে বেড়েছে অসুবিধা।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ওসব পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রকল্পের পাশেই আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩-এর অধীনে মুজিববর্ষের ৫০টি ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিকে তাদেরকে ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। গত ৪ এপ্রিল এসব ঘরের নির্মাণকাজ শুরু করে উপজেলা প্রশাসন। কিন্তু সেখানে বাধা দেয় স্থানীয় ৫ নম্বর আব্দুলপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত মকসেদ আলী সরকারের ছেলে সিরাজুল ইসলাম সরকার।
তার দাবি, ওখানে তিন একর জমি ১৯৬৬ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কিনেছেন। সেই জমিতে উপহারের ঘর নির্মাণ করছে প্রশাসন। এ ঘটনায় আদালতে মামলা করেছেন তিনি।
তবে উপজেলা প্রশাসন বলছে, যে মামলাটি হয়েছে ওই মামলার রায় সরকারের পক্ষে এসেছে। কারণ ওই খানে মোট খাস জমির পরিমাণ ১৩ একর ৭০ শতক। যার মধ্যে সিরাজুল ইসলাম ভোগ দখল করছেন তিন একর। বাকি জমিতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে সরকারি কাজে সিরাজুল ইসলামের বাধা দেওয়া বেআইনি।
চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, রেল সেতু এলাকায় একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প আছে। কিন্তু সেখানের ঘরগুলো বসবাসের অনুপযোগী। তারই সামনে আশ্রয়ণ প্রকল্প-৩-এর অধীনে ৫০টি বাড়ি নির্মাণ করা হবে। সিরাজুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তি ওই জমিতে কাজ করতে বাধা দিচ্ছেন তিনি ১৯৬৬ সালে ৩ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছেন। আমরা সেই জমিতে কাজ করছি না। কিন্তু ওই ব্যক্তি তিন একর ছাড়াও অতিরিক্ত জমি দখল করে আছেন। আবার তিনি বন্দোবস্ত গ্রহণ করে অনেক জমিই স্ট্যাম্পের মাধ্যমে হাতবদল করেছেন, যা আইনত অপরাধ। তিনি যদি আদালতের আদেশ নিয়ে আসেন তাহলে অন্য পদক্ষেপ নেবো আমরা।