চট্টগ্রাম বন্দরে ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো ২৬৫ কনটেইনার দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ পড়ে আছে। বন্দরের শেডে বছরের পর বছর পড়ে থাকলেও এসব পণ্য খালাস নেননি আমদানিকারকরা। এ অবস্থায় চলতি মাসেই নিলামে উঠছে ৪১ কনটেইনার বিপজ্জনক রাসায়নিক। বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে নিলামে উঠবে।
সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ সরাতে তোড়জোড় শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগামী ২৮ জুন ৪১ কনটেইনার রাসায়নিক নিলাম হওয়ার কথা রয়েছে।
এর আগে গত ৬ জুন বন্দরে পড়ে থাকা ৩০ টন হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিলামে তুলেছিল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এসব রাসায়নিক পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
বন্দর সূত্র জানায়, ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো বিপজ্জনক রাসায়নিক ভর্তি ২৬৫ কনটেইনার এখনও বন্দরে পড়ে আছে। এসব রাসায়নিক বন্দরের জন্য হুমকি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে এসব পণ্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কাস্টমসকে চিঠি দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠি পেয়েই কাজ শুরু করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্দরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ বছর আগের পণ্যও রয়েছে। তবে ১০-১৫ বছর ধরে পড়ে আছে এমন পণ্য বেশি। বিপদজ্জনক পণ্য ভর্তি অনেক কনটেইনার জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। অনেক কনটেইনার থেকে বেরিয়ে এসেছে ভেতরের মালামাল।
বন্দরের ১৪টি শেডের মধ্যে ‘পি’ শেডে এসব বিপজ্জনক পণ্যগুলো রাখা হয়েছে। এখানে ড্রাম, কার্টন ও বস্তাবোঝাই করে এসব পণ্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, সালফেট, সালফিউরিক অ্যাসিড, থিনার, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইড, ফার্মাসিউটিক্যালসের কাঁচামাল, রং তৈরির কাঁচামাল, টেক্সটাইল কাঁচামালসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পণ্য। যার বেশির ভাগই দাহ্য ও বিস্ফোরকজাতীয়।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার উপ-কমিশনার আলী রেজা হায়দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বছরের পর বছর বন্দরে পড়ে থাকা ২৬৫টি কনটেইনারের বিপজ্জনক পণ্যের তালিকা আমরা হাতে পেয়েছি। এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সার্ভারে যাচাই করে দেখেছি, পণ্যবোঝাই ২৮টি কনটেইনার আমদানিকারকরা খালাস নিয়েছেন। তবে তালিকায় থাকা ৪৪টি কনটেইনারের পণ্যের মেয়াদ নেই। এগুলো ধ্বংস করতে হবে। ৪১ কনটেইনার পণ্যের নিলাম চলমান। ৪১ কনটেইনার ভর্তি দাহ্য ও রাসায়নিক আগামী ২৮ জুন নিলামে তোলা হবে। এছাড়া ৫৫টি কনটেইনার যাচাই করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো নিলামে তোলা হবে। অন্যগুলো ধ্বংস করা হবে। অসম্পূর্ণ তথ্য রয়েছে এমন ৫৭টি কনটেইনার যাচাই-বাছাই করে দেখছি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা যেগুলো নিলামযোগ্য সেগুলো বিক্রি করবো। ধ্বংসযোগ্য পণ্যের বিষয়ে মতামত জানতে পরিবেশ অধিদফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব বিপজ্জনক পণ্য কীভাবে কোথায় ধ্বংস করা যেতে পারে, সে বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের মতামত পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালাস না নেওয়া বিপজ্জনক পণ্যবোঝাই কনটেইনার বন্দরে পড়ে আছে। এসব পণ্য নিলামে বিক্রি করে দিতে আমরা কাস্টমসকে প্রতি মাসে চিঠি দিই। তারা নিলামে ওসব পণ্য বিক্রি দেয়।’
২০২০ সালের ৪ আগস্ট লেবাননের বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই দুর্ঘটনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হন। বিপজ্জনক রাসায়নিক থেকে ওই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দর বিপজ্জনক পণ্য সরাতে তৎপর হয়ে ওঠে। তখন তালিকা তৈরি করে কিছু পণ্য ধ্বংস করা হয়। আরও কিছু পণ্য নিলামে বিক্রি করা হয়। ওই সময় জটিলতার কারণে কিছু বিপজ্জনক পণ্য থেকে যায়। সেই সঙ্গে বছর বছর আরও অনেক পণ্য জমা হয় বন্দরে।
আমদানিকৃত মালামাল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড় না নিলে তা নিলামের ব্যবস্থা করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিছু পণ্য থাকে ধ্বংসযোগ্য। ধ্বংসযোগ্য পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়তে হয় বন্দর সংশ্লিষ্টদের। এছাড়া যেকোনো স্থানে এগুলো ধ্বংস করা যায় না। সিলেটে একটি নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে, যেখানে এসব পণ্য ডাম্পিং এবং ডিস্ট্রাকশনের ব্যবস্থা রয়েছে, এগুলো সেখানে নিয়ে যায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
সর্বশেষ গত ৭ জুন বন্দর ইয়ার্ডে চার বছর ধরে পড়ে থাকা অ্যাসিডবোঝাই একটি কনটেইনার থেকে ধোঁয়া বের হয়। এ কারণে বন্দর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই কনটেইনার সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।
এর আগে ১৩ মে ব্যাটারি ও ইলেকট্রনিক পণ্যবোঝাই একটি কনটেইনারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে কনটেইনারের ভেতরে থাকা পণ্য পুড়ে যায়। ২০২০ সালের জুনে অগ্নিদুর্ঘটনায় বন্দরের একটি শেড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল নিউমুরিং টার্মিনাল চত্বরে মিথানলভর্তি ড্রামে বিস্ফোরণ ঘটলে চার শ্রমিক আহত হন।
এদিকে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর আমদানিকারকদের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছে কাস্টমস হাউস।
৭ জুন এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস থেকে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের চালান বন্দরে অবতরণের ৩০ দিনের মধ্যে এবং বিমানবন্দরে অবতরণের ২১ দিনের মধ্যে, অথবা উভয় ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত অতিরিক্ত সময়সীমার মধ্যে শুল্ককর পরিশোধ করে খালাস নিতে হবে।’
গণবিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আমদানিকারকরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস নিচ্ছেন না। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অধিক্ষেত্রাধীন চট্টগ্রাম বন্দর, সব অফডক ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমে আমদানিকৃত ও অখালাসকৃত কেমিক্যাল জাতীয় পণ্যসহ সব পণ্য চালান দ্রুত খালাস নেওয়ার জন্য আমদানিকারকদের অনুরোধ করা হলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অখালাসকৃত পণ্য বিধি মোতাবেক নিলামে বিক্রি করা হবে।’