‘বন্যায় সব শেষ করে দিছে। গোলার ধান, গরু-বাছুর ক্ষেতখামার কুন্তা (কিছু) নাই। মাইনসে দিলে খাই না দিলে খাওন নাই। ঘরে চাল-ডাল-লবণ-আদা কিছুই নাই, এবার ঈদ করমু কী দিয়া?’
কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের হাসনাবাদ গ্রামের মৃত সোনা উল্লাহর স্ত্রী রহিমা বিবি। এবারের ভয়াবহ বন্যা রহিমা বিবির মতো হাজারও মানুষকে সর্বশান্ত করে দিয়েছে। মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। স্বচ্ছল মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। শ্রমজীবীরা হারিয়েছেন কর্মসংস্থান। নিম্নবিত্তরা হয়েছেন দরিদ্র। সীমাহীন অভাব-অনটনে দিন কাটছে সুনামগঞ্জের হাজারও মানুষের। হাসনাবাদ গ্রামের কোরবানি দেওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।
ওই গ্রামের আলিফ জান বিবি বলেন, ‘আমার বয়স ৮৫ বছর। অনেক বন্যা দেখছি কিন্তু এমন বন্যা দেখি নাই। চোখের পলকে সবকিছু ভাসাইয়া নিয়া গেছে। হাড়ি-পাতিল, লেপ-তোশক, ঘর-বাড়ি সব নিয়া গেছে। এখন আর নেওয়ার মতো কিছু নাই। যেখানে চাল-চিড়া দেয় সেখানেই গিয়ে হাজির হই।’
ইনাতনগর গ্রামের আজিবুন্নেচ্ছা বলেন, ‘তিন দিন পরে ঈদ। ঘরে কিছু নাই। কোরবানির মাংসের লাগি টাউনও (শহরে) যাইমু। মাইনসে মাংস দিলে পোলাপান লইয়া রাইতে ভাত খাইমু ‘
হাসনাবাদ গ্রামের ছুরতুনেছা বলেন, ‘দুইটা ছাগল পানির কারণে মরছে। ঘরে কিছু ধান চাল আছিলো, কিন্তু বানের পানি সব শেষ করে দিছে। এখন মানুষের হাতের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া কোনও উপায় নাই।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘দুর্গতদের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার প্রয়োজন। জেলার শতভাগ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প নেওয়া উচিত।’
জেলা ত্রাণ অফিসের হিসাবমতে, এবারের বন্যায় ৪৫ হাজার বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ হাজার হেক্টর ধান ও ২৫ হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এক হাজার ৬০০ গবাদিপশু ও তিন লাখ হাস-মুরগি মারা গেছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রায়হান কবির জানান, বন্যায় যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ তহবিল থেকে প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে। উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ৫০৮টি পরিবারের মাঝে এই সহায়তা প্রদান করা হবে।
এদিকে ছাতক উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের টাকা বিতরণ কার্যক্রম চলছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি সংস্কারের জন্য উপজেলায় ৫৭৫ জনকে নগদ ১০ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হচ্ছে। এর আগে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তত করা হয়। তালিকায় স্থান পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তদের দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়; সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। সম্পূর্ণ বা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ৫৭৫টি পরিবারকে ঘর সংস্কার করার জন্য ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করা হচ্ছে। উপজেলার ৫৭৫ পরিবারের মাঝে ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে।
জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ঈদের জন্য বিশেষ ভিজিএফ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকার-বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে হবে।