মাঠজুড়ে সোনালি স্বপ্ন। শীষজুড়ে ধানের গোছা কারও কারও উঠান ভরে তুলেছে। কারও উঠানে চলছে প্রস্তুতি। বরেন্দ্রজুড়ে সে ধানের ঘ্রাণেই বাঙালির ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব চলমান।
চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি ও পরে অতিবর্ষণের ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন কৃষকরা। কিন্তু সব শঙ্কা ছাপিয়ে এবার রাজশাহী জেলায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আবাদ হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে বাজারে ধানের দামও ভালো। এতে খুশি চাষি। ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবেরও তাই ভিন্ন আমেজ।
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাঠজুড়ে দলবদ্ধভাবে এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। মাঠে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। কেউ ধান কেটে জমি খালি করছেন, আবার কেউ মাড়াই শেষে ধান বস্তায় ভরে বাড়িতে তুলছেন। বাম্পার ফলনের আনন্দে কৃষকরা নতুন স্বপ্ন বুনছেন। কৃষকদের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস দেখা যাচ্ছে। কারণ বাজারে এখন নতুন আমন ধানের মণ ১৩০০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের শুরুতে বাজারে ধানের ভালো দাম পাচ্ছেন তারা।
সোমবার (১৮ নভেম্বর) সকালে বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে নবান্ন উৎসব পালন করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় পিঠা উৎসব, নাচ-গান আর আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানটি পালিত হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। বাম্পার ফলন হয়েছেও। এখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে আমনের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩ হাজার ৫৬৭ হেক্টর। আর আবাদ হয়েছে ৮৪ হাজার ১০৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ পাঁচ হাজার ৭৬২ মেট্রিক টন। এখন পর্যন্ত মোট আবাদের ২০ শতাংশের বেশি জমির ধান কর্তন করা হয়েছে।
এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮১ হাজার ৭৫৯ হেক্টর। আবাদ হয়েছিল ৮৩ হাজার ১৭৭ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল দুই লাখ ৯১ হাজার ৬২ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮০ হাজার ৫০ হেক্টর। আবাদ হয়েছিল ৮০ হাজার ৮৩২ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৮৬ হাজার ১৪৫ মেট্রিক টন।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের আমন মৌসুমে শুরুতে অনাবৃষ্টি ও পরে অতিবর্ষণের কারণে কিছু কিছু জমিতে ধানের ক্ষতি হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাম্পার ফলন হয়েছে। অনেক জমিতে ডুবে যাওয়ার ফলে ফলন কম হয়েছে, তবে এতে পুরো চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক আফজাল হোসেন জানান, তার আড়াই বিঘা জমিতে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। পানির খরচ কিছুটা বেশি হলেও ফলন আশানুরূপ হচ্ছে। প্রতিটি বিঘায় ২২ মণের বেশি ধান হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক শহীদুল ইসলাম জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন, মোটামুটি ভালো ফলন পেয়েছেন। বন্যার সময় কিছু জমি ডুবে গিয়েছিল, তবে বাকি জমিতে ভালো ফসল হয়েছে। তিনি আশাবাদী, এ মৌসুমে লাভবান হবেন।
পবা উপজেলার কৃষক বারিউল হক বলেন, এবার আমন ধানের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাম্পার ফলন পেয়েছি। আমার তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছি, আর প্রত্যেক বিঘায় ২০ মণের বেশি ফলন হয়েছে। ধানের দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, এবার খরচ তোলার পর হাতে ভালো পরিমাণ টাকা থাকবে। এই ফলন আমাদের পরিবারের জন্য অনেক স্বস্তি এনে দিয়েছে।
দুই বিঘা জমিতে আমন আবাদ করেছেন দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক বাবার মাহমুদ। তিনি বলেন, এবার ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। তবে বন্যার সময় ধানক্ষেতের কিছু অংশ ডুবে গিয়েছিল। ডুবে যাওয়া অংশে ফলন কম হয়েছে। তবে বেশিরভাগ জমিতে ভালো ফলন হয়েছে। আশা করছি, লাভবান হবো।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে, বারো মাসে তেরো পার্বণ। হেমন্তের অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব তারই একটি। বাঙালি জাতির হাজারো বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি মধ্যে রয়েছে নবান্ন উৎসব। নবান্ন শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’ বা ‘নব অন্ন’। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি করা চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত বাংলা অগ্রহায়ণ মাসে অর্থাৎ হেমন্তকালে আমন ধান পাকার পর এই নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপনের প্রথাও রয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিনেই ধান কেটে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। সেখানে নতুন ধানের চালের ক্ষীর, পায়েস, পিঠা পুলিরও আয়োজন করা হয়। আয়োজন করা হয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুরে জাতীয় পদক প্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামান মনিরের আয়োজনে নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠানে আদিবাসী মেয়েরা ধান কেটে বরেন্দ্র অঞ্চলের আদি কৃষির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পালন করেন।
অনুষ্ঠানে স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ বলেন, এই নবান্ন উৎসব কৃষকের সারা বছরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। এমন আয়োজন এখন কমে গেলেও চৈতন্যপুর গ্রামে নতুন মাত্রা পেয়েছে কৃষক মনিরের কারণে।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহমেদের সভাপতিত্বে নবান্ন উৎসবে ধান কেটে উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের রাজশাহী (ভারপ্রাপ্ত)উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোসা. উম্মে ছালমা বলেন, এখন পর্যন্ত ২০ শতাংশের বেশি জমির ধান কাটা হয়েছে এবং ফলন ভালো হচ্ছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আবাদ হওয়ায় আশা করছি যে এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে। কৃষকরাও খুশি।