বোরোর মৌসুম শেষ হয়েছে জুন মাসে। বাংলা মাসের হিসেবে জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত চলে ধান কাটা ও মাড়াই। এরপর ধান বিক্রি হয়ে চালকল থেকে চলে আসে আড়তে। ইতোমধ্যে নতুন ধানের চাল আসতে শুরু করেছে আড়তগুলোতে। নতুন চাল বাজারে এলে সাধারণত দাম কমে। কিন্তু এবার বাড়ছে চালের দাম। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।
এবার বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। অথচ পর্যাপ্ত সরবরাহের পরও অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। গত এক মাসের ব্যবধানে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা পর্যন্ত। উৎপাদন খরচের কারণে চালের দাম বাড়াতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিকরা। আড়তদাররা বলছেন, মিল মালিকরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় তাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি আড়তে চালের দাম বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া গেছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁর বিভিন্ন বাজারে প্রতি বস্তায় (৫০ কেজি) চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা। খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চালের দাম বেড়েছে ২ থেকে ৪ টাকা।
মিল মালিকদের ভাষ্য, মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা আঠাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ থেকে ৩২০০ টাকায়, যা কিছুদিন আগেও ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মোটা চাল (গুটি স্বর্ণা) প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায়, যা কিছুদিন আগে ২২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে জিরাশাইল চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৪০০ টাকায়। যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৩ হাজার টাকায়।
পাইকারি চাল বিক্রেতারা বলছেন, মিলার ও মৌসুমি ধান ব্যবসায়ীদের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর এই বাড়তি দর পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা সমন্বয় করছেন। ফলে চাল কিনতে বেশি টাকা খরচ হওয়ায় ক্রেতারা পড়ছেন বেকায়দায়।
রাজশাহী নগরীর সাহেববাজারের এপি চাউল ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী প্রকাশ প্রসাদ বলেন, আমরা সরাসরি মিল থেকে চাল নিয়ে আসছি। মিল থেকেই বাড়তি দামে বিক্রি করছে। সে জন্য আমাদের দাম বাড়াতে হচ্ছে। মিল মালিকরা যদি কম রাখে, তাহলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারবো।
রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল বিক্রেতা ফাতেমা রাইস এজেন্সির মালিক দাবিরুল ইসলাম বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বেড়ে চলেছে চালের দাম। প্রতিদিনই বাড়ছে। এ জন্য আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আশা করি চালের দাম কমলে আমরাও কম দামে বিক্রি করতে পারবো।
রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার ক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের সারা বছরজুড়েই বাজার থেকে চাল ক্রয় করতে হয়। ভেবেছিলাম, বোরো ধানের চাল বাজারে উঠলে দাম কমবে। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে বিক্রেতারা তা কম দামে বিক্রি না করে বেশি দাম নিচ্ছে। বাজার মনিটরিং আরও জোরদার করা উচিত। তাহলে সাধারণ ক্রেতারা একটু রক্ষা পাবেন।
এদিকে ধান ও চালের সবচেয়ে বড় মোকাম নওগাঁ জেলায়। মিল গেটে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্থানীয় বাজারে ধানের দাম প্রতি মণে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বাড়ার কারণে সরু ও মোটা চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে।
নওগাঁ মৌ অ্যাগ্রো অ্যারোমেটিক রাইস মিলের ব্যবস্থাপক ইফতারুল ইসলাম বলেন, কোরবানি ঈদের পর থেকে বাজারে জিরা ও কাটারি ধানের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই দুই প্রকার ধানের দাম বেড়েছে প্রতি মণে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
নওগাঁর রাণীনগর চাল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন খান বলেন, সরু ধান প্রতি মণে দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর প্রতি মণ চালের দাম বেড়েছে ১৫০ টাকা। এমন দাম কমবেশি সারা দেশে। বৃষ্টির কারণে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে- এটিও মূল্যবৃদ্ধির একটা কারণ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আনোয়ার অটোরাইস মিলের নিউ মার্কেটের চাল বিক্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা রুবেল আলী জানান, আঠাশ চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি, মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা কেজি দরে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিউমার্কেটের মুদি দোকানী বাবু জানান, চালকল মালিকরা চালের বস্তায় অন্তত ২০০ টাকা করে বৃদ্ধি করায় চালের দাম কেজি প্রতি ৩-৪ টাকা বেড়ে গেছে।
মেসার্স মনজুর অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপক ফারুক হোসেন জানান, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, চালের দাম বস্তা প্রতি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।
নাটোর শহরের চালের পাইকারি ব্যবসায়ী সুরেশ চন্দ্র শাহা বলেন, বড় ব্যবসায়ীরা ধান কিনে মজুত করার কারণে এবং বর্তমানে ধানের সরবরাহ কম থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নাটোর চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রব খান চৌধুরী বলেন, বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকা, বর্ষাজনিত কারণে ধান সেদ্ধ ও শুকাতে না পারায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া এবার সরকার গোডাউনে আগে ধান নেওয়ায় বাজারে মোটা চালের ঘাটতি পড়েছে। সে জন্য চিকন চালের ওপর চাপ পড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের রাজশাহীর উপ-পরিচালক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের অভিযান চলছে। চাল ব্যবসায়ীদের সতর্কও করা হচ্ছে। এরপরও যারা সতর্ক হচ্ছে না তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।