উত্তরের জেলা দিনাজপুরকে বলা হয় লিচুর রাজ্য। জেলায় উৎপাদিত লিচু স্বাদ ও মিষ্টিতে অনন্য। এখানের লিচু যায় সারাদেশে। এবার আগেভাবেই বাজারে উঠেছে মধুমাসের এই ফল। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই হরমোন ও কেমিক্যাল দিয়ে এসব কাঁচা লিচু পাকানো হয়েছে। ফলে এসব লিচু খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি এমনকি মৃত্যুও হতে পারে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারের অধিকাংশ লিচু অপরিপক্ব। বিষয়টি স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বেশি লাভের আশায় বাগানের মালিকরা কাঁচা লিচু বিক্রি করেছেন। তারা এসব লিচু কিনে বাজারে বিক্রি করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনাজপুরে প্রায় ছয় হাজার ৫৪৬ হেক্টর জমিতে লিচু গাছ রয়েছে। লিচু বাগানি রয়েছেন প্রায় ৭০০ জন। এছাড়া বাড়ির উঠান ও আশপাশে লিচুর গাছ আছে আরও এক হাজার। এসব লিচুর মধ্যে রয়েছে মাদ্রাজি, মুম্বাই, বেদেনা, চায়না থ্রি ও কাঁঠালি। প্রকারভেদে এসব লিচু পর্যায়ক্রমে বাজারে আসে। লিচু নামানোর নির্দিষ্ট সময় রয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, মে মাসের শেষের দিকে বাজারে আসে মাদ্রাজি লিচু। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১০ জুন) বেদেনা, ২০ জুন মুম্বে, জুনের শেষ দিকে চায়না থ্রি ও কাঁঠালি লিচু বাজারে আসে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, মাদ্রাজি লিচু চলতি মাসের শেষের দিকে বাজারে আসবে। তবে চলতি মাসের শুরু থেকে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে মাদ্রাজি লিচু। এসব লিচু অপরিপক্ব। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
জেলা শহরের বাহাদুর বাজার এলাকায় দেখা গেছে, মাদ্রাজি লিচু বিক্রি করছেন ইসমাইল হোসেন। তার লিচু কাঁচা। যা পরিপূর্ণভাবে পাকতে আরও প্রয়োজন ১০ থেকে ১২ দিন। ১০০ লিচু তিনি বিক্রি করছেন ২২০ টাকা।
ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বাগান মালিকরা অতিরিক্ত লাভের আশায় অপরিপক্ব লিচু বিক্রি করছেন। ক্রেতাদের আগ্রহ থাকায় আমরাও অপরিপক্ব লিচু কিনে কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করছি।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিপক্ব লিচু খেলে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। কাঁচা বা আধাপাকা লিচুতে থাকা টক্সিন হাইপোগ্লাইসিন এ এবং মিথাইলিন-সাইক্লো-প্রোপাইল-গ্লাইসিন নামক টক্সিন উপাদান বিষক্রিয়া ঘটিয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে।’
জানা গেছে, ২০১৫ সালে অতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া অপরিপক্ব লিচু খেয়ে ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ওই সময়ে নমুনা সংগ্রহ করেছিল ‘আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’ নামের একটি সংস্থা। ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে উল্লেখ করা হয়, লিচুতে বিষাক্ত কীটনাশক এনডোসালফেন ব্যবহার করা হয়েছিল। লিচুতে ব্যবহৃত ওই বিষ শিশুদের পেটে যাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে ২০১২ সালে ১৫ দিনের ব্যবধানে দিনাজপুরে ১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।
বিরল উপজেলার বহলা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের জেলা লিচুর জেলা হিসেবে পরিচিত। নতুন ফল বাজারে উঠেছে। এজন্য ১১০ পিস লিচু ২২০ টাকায় কিনলাম। এসব লিচু কীভাবে পাকানো হয়েছে তা আমার জানা নেই।’
জেলা শহরের বালুয়াডাঙ্গা এলাকার বাদশা আলী বলেন, ‘বাগান মালিকরা বেশি টাকা পাওয়ার আশায় কাঁচা লিচু বিক্রি করছেন। তবু কিনলাম। নতুন ফল বাজারে আসায় নিয়েছি। দাম বেশি। এসব লিচু এখনও পাকেনি।’
জেলার দশমাইল এলাকার শঙ্কর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি ঢাকায় ব্র্যাক ট্রেনিং সেন্টারে চাকরি করি। আজ বাড়ি এলাম। ট্রেন থেকে নেমে দেখি লিচু উঠেছে। নতুন ফল তাই কিনলাম। নতুন ফল হিসেবে দামটা একটু বেশি। তবে এখনও এসব লিচু পাকেনি। ক্ষতির বিষয়টি জানা ছিল না।’
রাজবাটী গ্রামের পিয়াস সরকার বলেন, ‘বাজারে যে লিচুগুলো উঠেছে তা অনেক টক। এখনও পাকেনি। লিচু পাকতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগবে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় আগেভাগে কাঁচা লিচু বিক্রি করছেন বাগান মালিকরা। যারা কিনছেন তারা ঠকছেন এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।’
ফল বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে ফলের ব্যবসা করি। এখনও পাকেনি লিচু। আমি আড়ত থেকে লিচুর শ’ ১৬০ টাকা কিনেছি। বিক্রি করছি ২০০ থেকে ২২০ টাকা। আরও এক সপ্তাহ পর পাকা লিচু বাজারে আসবে। তবে এখন অপরিপক্ব লিচু কিনছেন ক্রেতারা।’
দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘দাম বেশি পাওয়ার জন্য কেমিক্যাল মিশিয়ে কাঁচা লিচু বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব লিচুতে অধিক পরিমাণ কেমিক্যাল আছে। এই লিচু খেলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হবে।’
ডায়াবেটিস ও স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ ডা. ডিসি রায় বলেন, ‘অপরিপক্ব লিচুতে মিথাইলিন-সাইক্লো-প্রোপাইল-গ্লাইসিন নামক টক্সিন থাকে। যা থেকে মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতিকর। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. এ এইচ এম বোরহান-উল-ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘অপরিপক্ব লিচুতে অ্যানজাইম থাকে। এই লিচু খালি পেটে খেলে তীব্র গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। সাধারণত লিচু গাছে অরগানো ফসফরাস কোম্পাউন্ট নামের এক ধরনের কীটনাশক স্প্রে করা হয়। এই কীটনাশক প্রয়োগের পর নির্ধারিত সময়ের আগে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। অতিরিক্ত লাভের আশায় বাগান মালিকরা এসব লিচু বিক্রি করছেন। তবে এটি খাওয়া ঠিক নয়। অপরিপক্ব লিচু খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হবে। শিশুদের জন্য এই লিচু সবচেয়ে ক্ষতিকর। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমরা বাজারে দেখেছি কাঁচা লিচু বিক্রি হচ্ছে। কারণ এখনও লিচু বাজারে উঠার সময় হয়নি। এ বিষয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলা প্রশাসক আমাদের সঙ্গে সভা করবেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অভিযান পরিচালনা করবো।’
জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তা মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘লিচুর বাইরে রঞ্জক ব্যবহারের কথা আমরা শুনেছি। এই বিষয়ে কৃষি অধিদফতরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। এছাড়া জেলা নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা বাজার পরিদর্শন করবো।’
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মারুফ আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে যে লিচুগুলো বাজারে এসেছে সেগুলো কৃত্রিম উপায়ে পাকানো। তবে কোন কেমিক্যাল ব্যবহার করে পাকানো হয়েছে, মাত্রা কতটুকু রয়েছে তা জানতে হবে। অপরিপক্ব লিচু না খাওয়াই ভালো। কারণ এসব লিচু টক। পাকা লিচুতে যে উপকারী উপাদান পাওয়া যায়, তা অপরিপক্ব লিচুতে নেই। তবে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে।’
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক প্রদীপ কুমার গুহ বলেন, ‘সালফার বেইস কন্টেইন কেমিক্যাল স্প্রে করে এবং গ্রোথ রেগুলেটর দিয়ে পাকানো হচ্ছে কাঁচা লিচু। এসব কেমিক্যাল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। গাছের ফল স্বাভাবিকভাবেই পাকবে। এজন্য কেমিক্যাল ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। অতি লোভে কেউ কেউ কেমিক্যাল দিয়ে লিচু পাকিয়ে বিক্রি করছেন। আমরা এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি বাগান মালিকদের। কিন্তু যারা এসব বিক্রি করছেন তারা ব্যবসায়ী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’