রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম স্থবির হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে হত্যা মামলার বাদীসহ নিহত মুহিবুল্লাহর পরিবারের ২৫ সদস্যই কানাডা চলে গেছেন। যে কারণে এ মামলার বিচার কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, রোহিঙ্গা নেতা আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর তার ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন।
এ মামলা দীর্ঘ ৮ মাস ১৩ দিন তদন্তকালে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ৩৬ জনের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। পরে গত ১৩ জুন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন উখিয়া থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজী সালাহ উদ্দিন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আরসার সংগঠনের ৩৬ সদস্য পরিকল্পিতভাবে মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে। তবে আদালতে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র প্রদান করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অভিযুক্ত ২৯ জন আসামি হলেন- আরসা নেতা ও উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের নুর বশরের ছেলে মোহাম্মদ ছলিম, একই ক্যাম্পের শওকত উল্লাহ, মোহাম্মদ সালাম, জিয়াউর রহমান, মো. ইলিয়াছ, মো. আজিজুল হক, মোর্শেদ ওরফে মুর্শিদ, নুর মোহাম্মদ, আনাস, নজিম উদ্দিন, আবুল কালাম ওরফে আবু, হামিদ হোসেন, সিরাজুল মোস্তফা ওরফে সিরাজুল্লাহ ওরফে সিরাজ, মৌলভি মো. জকোরিয়া, খাইরুল আমিন, মাস্টার আবদুর রহিম ওরফে রকিম, জাহিদ হোসেন ওরফে লালু, ফয়েজ উল্লাহ, ছমির উদ্দিন ওরফে ছমি উদ্দিন ওরফে নুর কামাল, সালেহ আহমদ, মোজাম্মেল ওরফে লাল বদিয়া, তোফাইল, মাস্টার শফি আলম, আবদুস সালাম ওরফে জাকের মুরব্বি, জকির, হাফেজ আয়াছ, মাস্টার কাশিম, মাস্টার শুক্কুর আলম ও মোস্তফা কামাল।
এদিকে নাম ও ঠিকানা শনাক্ত করতে না পারার ওজুহাত দেখিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনিসহ ৭ জনকে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়। তারা হলেন- আরসার প্রধান জুনুনি, ওস্তাদ খালেদ ওরফে খালিদ, ওস্তাদ হাশিম, ইব্রাহিম, আলমগীর, শুভ ওরফে আলমগীর ও মৌলভি মোস্তাক।
আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিদের কয়েকজন ঘটনার সঙ্গে জুনুনিসহ ৭ জনের সম্পৃক্ত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তাদের বাদ দিয়ে মোটা অংকের বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ ওঠে।
স্থানীয় রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, যার নির্দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ তার নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি এনজিওর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা মোটা অংকের লাভবান হয়েছে।
তবে অভিযোগের কথা অস্বীকার করে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা উখিয়া থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) গাজী সালাহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মামলায় বাণিজ্যের কথা সঠিক নয়। বরং মামলার বাদীকে নিজে টাকা দিয়ে অনেকবার চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করে দিয়েছেন তিনি।
এদিকে মুহিবুল্লাহা হত্যাকাণ্ড বা মামলার বিচার কার্যক্রম নিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রমে ‘বাদী ও সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে’ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ঘটনার পট পরিবর্তনের পর সম্প্রতি কানাডার উদ্দেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছাড়েন মুহিবুল্লাহর পরিবারের ১৪ সদস্য।
এর আগে, গত ৩১ মার্চ মুহিবুল্লাহর স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের ১১ জন সদস্যকে কানাডা নিয়ে যাওয়া হয়। সুতরাং এক কথায় বলা যায় মামলা সংশ্লিষ্ট বাদী, সাক্ষীসহ অধিকাংশই কানাডায় চলে গেছেন।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২৯ জনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৩ জুন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৯ আসামির বিচার শুরু হয়। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল মামলার চার্জশিটভুক্ত সব আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ওই দিন আদালতে মামলার ১৫ জন আসামি উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে এই মামলার ১৪ জন আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন।
আদালত সূত্র আরও জানিয়েছে, গ্রেফতার ১৫ জনের মধ্যে ৪ জন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একই সঙ্গে ৩ জন সাক্ষীও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে এখনো পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া রয়েছে বলে জানান কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, মামলাটির সাক্ষী শুরু হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হবে। যাতে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সাক্ষ্য নেওয়া যায়। তবে সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে না এলে বিচার কার্যকম স্থবির হয়ে পড়বে বলেও স্বীকার করেন রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী।