বিদেশ থেকে ফিরে বাড়ির ছাদে দৃষ্টিনন্দন বনসাই বাগান করেছেন সাজ্জাদ হোসেন। বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা থেকেই এ বাগান করেছেন। কয়েক বছরের ব্যবধানে বনসাই রাজ্য গড়ে তোলেন। এখন সবুজে ঢেকে গেছে বাড়ির ছাদ। তার বাগানে দেশি-বিদেশি তিন শতাধিক বনসাই রয়েছে। বাড়ির ছাদে বৃক্ষগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
যশোর পৌর শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাগমারা রোডের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেন। একান্নবর্তী পরিবারের তিনটি বাড়ির ছাদে তিন শতাধিক বনসাই রয়েছে তার। সেখানে শোভা পাচ্ছে শ্বেতচন্দন, বট, পাকুড়, অ্যাডোনিয়া, তেঁতুল, অর্জুন ও বাগান বিলাস ইত্যাদি। এর মধ্যে আড়াইশ’র বেশি রয়েছে শ্বেতচন্দন। বাগানে আট বছরের একটি শ্বেতচন্দন বৃক্ষ রয়েছে। এটির দাম লাখ টাকার ওপরে।
সাজ্জাদ মালয়েশিয়া প্রবাসী ছিলেন। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ার কুলাই এলাকায় কাজ করতেন। সেখানে একদিন মোবাইল ফোনে ফ্লেক্সিলোড দিতে যান এক চীনা নাগরিকের প্রতিষ্ঠানে। ওই প্রতিষ্ঠানে দেখতে পান নান্দনিকভাবে সাজানো ১৭টি বনসাই। সেগুলোর মধ্যে ছিল চায়না বট ও তেঁতুল ইত্যাদি। বনসাইগুলো তাকে অনুপ্রাণিত করে। সেগুলো দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে ফিরে বনসাই বাগান করার সিদ্ধান্ত নেন সাজ্জাদ।
দেশে ফেরার পর ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বনসাই বাগান তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে বৃক্ষের জন্য বিভিন্ন ধরনের টব ব্যবহার করলেও পরে প্লেট আকৃতির পাতলা পাত্র ব্যবহার করেন। যশোর সদর উপজেলার বনবিভাগের (ঝুমঝুমপুর এলাকা) নার্সারি থেকে শ্বেতচন্দনের চারা সংগ্রহ করেন।
সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘দেশে ফিরে নানা গাছের প্রদর্শনী দেখেছি। কিন্তু চীনা ওই নাগরিকের বনসাই বাগান আমার মনে আজও গেঁথে আছে। শ্বেতচন্দন এখন বিলুপ্তপ্রায়। আমি চেয়েছি, ঔষধি গুণের খনি ভেষজ শ্বেতচন্দন বৃক্ষটি মানুষের হাতের নাগালেই থাকুক। এই বৃক্ষের কষ অ্যান্টিসেপটিক; রয়েছে সুগন্ধ। প্রথমদিকে বট ও পাকুড়ের বনসাই করেছিলাম। কিন্তু অনেকের এলার্জি আছে এসব বৃক্ষে। কুসংস্কার রয়েছে অনেকের। তারা চান না বাড়িতে বট বা পাকুড় থাকুক। সে কারণে মূলত শ্বেতচন্দনের বনসাই করেছি। বাগানে আট বছরের একটি শ্বেতচন্দন বৃক্ষ রয়েছে। এটির দাম লাখ টাকার ওপরে।’
তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে বনসাইয়ের উচ্চতার একটি স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। মাটি থেকে বৃক্ষের উচ্চতা হবে ১৮ ইঞ্চি; আমি সেগুলো মেনেই বাগান করেছি।’
বনসাই তৈরিতে কারও কাছে কোনও ধরনের প্রশিক্ষণ নেননি সাজ্জাদ। ব্যবহার করেন না কোনও অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। শুরুর দিকে নিয়মিত যাতায়াত করতেন যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরিতে। ঘেঁটেছেন এ সংক্রান্ত বই। এসব বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন থেকে বনসাই তৈরির প্রণালী, গাছের খাবার ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা নেন।
বাড়ির ছাদে ওঠার আগে একটি বড় বারান্দায় করেছেন বনসাইয়ের ল্যাব। এরপর সিঁড়ির সংযোগস্থলে বড় একটি ড্রামে রেখেছেন বেশ কিছু কই মাছ। অবশ্য এসব মাছ তিনি কেনেননি। ঘরের পাশে একটু ঢালু মাঠে বর্ষার সময় কই মাছ ওঠে। সেখান থেকে মাছগুলো ধরে ড্রামে রেখেছেন। নিয়মিত মাছগুলোকে ভুট্টা, গম ও খৈল ইত্যাদি খেতে দেন। ড্রামের পানি তিন দিন পরপর পরিবর্তন করেন। সেই পানি প্রত্যেকটি গাছে দেন। এখান থেকেই প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় বৃক্ষগুলো। এছাড়া মাটি তৈরির প্রক্রিয়া আর বৃক্ষের কিছু খাবার রয়েছে; সেগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাননি তিনি।
সাজ্জাদের প্রত্যাশা জেলা শহরে বনসাইয়ের বড় বাজার সৃষ্টি করবেন। সে কারণে দিনরাত পরিচর্যা করেন বাগানের। চারা সংগ্রহ, তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি নিয়েই ভাবনা। আগামী দুই বছরের মধ্যে তিনি বড় ধরনের একটি প্রদর্শনী করতে চান। তারপরই বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা।
বনসাই হলো শক্ত কাণ্ড বিশিষ্ট বৃক্ষকে নান্দনিকভাবে খর্বাকৃতি করার শিল্প। গাছের গড়ন নির্ণয় থেকে শুরু করে তাতে পানি দেওয়া তথা বাঁচিয়ে রাখা এবং যে পাত্রে চাষ করা হয় তা নির্ধারণ এবং প্রতিস্থাপন সবই এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রাচীন চীনা শব্দ ‘পেনজাই’ থেকে জাপানি ‘বনসাই’ শব্দের উৎপত্তি। বনসাইয়ে ব্যবহৃত ট্রের মতো যে পাত্র ব্যবহার করা হয়, তাকে সাধারণভাবে ‘বন’ বলা হয়। পাশ্চাত্যে পাত্রে খর্বাকৃতির গাছ বলতে ‘বনসাই’ বোঝায়।
বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকে বনসাই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকে শখের বশে করলেও এখন এটিকে উপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বনসাই সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দা আমিনা হক মিনা বলেন, ‘বনসাইয়ের বাজার এখনও সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। আমরা চেষ্টা করছি। ঢাকায় বনসাইয়ের প্রদর্শনী করা হয়। সেখানে অনেকেই গৃহ সাজাতে এগুলো কিনে থাকেন।’
এক হাজার টাকার নিচে কোনও বনসাইয়ের দাম নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এক থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বনসাই বিক্রি করেছি। প্রায় সব ধরনের গাছের বনসাই রয়েছে।’
তবে বনসাই বাগানকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখেন যশোর সরকারি এমএম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক জিল্লুর বারী।
তিনি বলেন, ‘এটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ। একটি উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বিকাশ তার অধিকার। বনসাই তৈরি সেই অধিকার খর্ব করে খর্বাকৃতির রূপ দিচ্ছে। কেবলমাত্র বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কতিপয় মানুষের সৌন্দর্যের উপকরণ বানাতে এটি করা হচ্ছে। বৃক্ষের ওপর এমন অত্যাচারের কারণে প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রকৃতি। সে কারণে আমরা নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ছি। নানা ধরনের রোগবালাই আসছে পৃথিবীতে। বাস্তবে বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। অর্থাৎ প্রতিটি জিনিসই স্ব-স্ব স্থানে সুন্দর ও মানানসই।’