দেশের বাজারে ভালো চাহিদা ও দাম পাওয়ায় সরিষা চাষ লাভজনক হওয়ায় দিনাজপুরের হিলিতে এবারে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে সরিষার চাষ। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া ভালো থাকায় সরিষার ভালো ফলনের সঙ্গে সঙ্গে ভালো দাম পেলে বাড়তি লাভের আশা কৃষকদের। ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে ও কৃষকদের উৎপাদিত সরিষা দিয়েই স্থানীয় ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে এবং সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে সরকারি প্রণোদনাসহ সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয় কৃষি বিভাগের।
‘শস্যভান্ডার’ খ্যাত হিলির বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এখন হলুদের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ ছেয়ে গেছে সরিষার হলুদ ফুলে। সবুজের মাঝে হলুদের মেলা প্রকৃতিকে সাজিয়েছে অপরূপ সাজে। হলুদের মৌ মৌ গন্ধে মুখরিত হয়ে পড়েছে পুরো এলাকা। চারদিকে শুধু হলুদ আর হলুদ। তবে এমন অবস্থা আগে ছিল না। আমন ধান কাটার পর বোরো ধান রোপণের আগপর্যন্ত অধিকাংশ জমি পড়েই থাকতো। সরকারিভাবে কৃষকদের বিনা মূল্যে সরিষার বীজ ও সার দেওয়ায় এবং সরিষা চাষে কোনও ঝামেলা না থাকায় আগ্রহী হচ্ছেন অনেক চাষি। এতে কোনও ধরনের সেচ দিতে হয় না, যার কারণে খরচ কম ও লাভজনক হওয়ায় পতিত জমিতে বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির ফলেও পরিবারের ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে কৃষকদের সরিষা চাষে আগ্রহ আরও বেড়েছে।
হিলির চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক পলাশ বসাক বলেন, ‘সরকার যে কৃষি প্রণোদনা হিসেবে কৃষকদের মাঝে বিনা মূল্যে সরিষার বীজ ও সার বিতরণ করছে। এর ফলে কৃষকরা সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ হওয়ায় আমাদের এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে সরিষার আবাদ বাড়ছে। আগে তেমন সরিষার চাষাবাদ না হলেও বিগত দুই-তিন বছরে সরিষার চাষ বেড়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় সরিষা বেশ ভালো রয়েছে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন। সেই সঙ্গে চাষাবাদে কোনও ধরনের ঝামেলা নেই। জমিতে কোনও সেচ দিতে হয় না, তেমন সারের প্রয়োজন নেই। বাড়তি দেখাশোনার দরকার হয় না, শুধু বীজ জমিতে ছিটিয়ে দিলেই হয়।’ এতে করে আগামী দিনে এই অঞ্চলে সরিষার আবাদ আরও বাড়বে বলে দাবি তার।
হিলির ইসমাইলপুরের কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে আমরা কৃষকরা সরিষার আবাদ এই জন্যই করছি যে, আমন ধান কাটা-মাড়াইয়ের পর বোরো ধান রোপণের আগপর্যন্ত জমিগুলো আমাদের সব পড়েই থাকে। এতে কোনও ধরনের ফসল আবাদ হয় না। তাই জমি ফেলে না রেখে দোফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর ও বাড়তি লাভের আশায় আমরা কৃষকরা এই সরিষা চাষ করছি। সেই সঙ্গে যে হারে তেলের দাম বাড়ছে তাতে করে আমাদের পরিবারের জন্য তেল কিনতেও হিমশিম খেতে হয়। সেই কারণে পরিবারের তেলের চাহিদা মেটাতে এই সরিষা চাষাবাদ শুরু করেছি আমরা। এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষাবাদে আমাদের খরচ হয় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার মতো। আর আবহাওয়া ভালো থাকলে এক বিঘা জমিতে সরিষা হয় ৬ থেকে ৭ মণ করে। খুব ভালো হলে ৮ মণ পর্যন্ত হয়। কাঁচাতেই
যদি ২ হাজার টাকা মণ বিক্রি করা হয় তাতে আমাদের ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা লাভ হয়। সেই সঙ্গে পরিবারের তেলের যে চাহিদা সেটি এখান থেকে মেটানো সম্ভব হয়।’
একই গ্রামের কৃষক এজাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সরিষা চাষাবাদের মূল উদ্দেশ্য হলো, দুটি ধানের পর বাড়তি ফসল হিসেবে সরিষা পাচ্ছি। সেটি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছি। সেই সঙ্গে ক্ষেত থেকে সরিষা তুলে নেওয়ার পরে পরবর্তীতে বোরো ধান আবাদের সময় সরিষাতে দেওয়া সারগুলো জমির জন্য ভালো কাজে লাগে। এবার সরিষার ব্যাপক আবাদ হয়েছে, সেই সঙ্গে খুব সুন্দর হয়েছে। বর্তমানে যে আবহাওয়া রয়েছে তাতে আশা করছি, সরিষার খুব ভালো ফলন হবে। কাঁচাতেই যদি গতবারের মতো দুই হাজার থেকে ২২০০ টাকা দাম পাই, তাহলে ভালো লাভবান হতে পারবো।’
হিলির ছাতনি গ্রামের কৃষক আব্দুল খালেক বলেন, ‘যখন থেকে তেলের দাম বেড়েছে তখন থেকেই সরিষার চাষাবাদ বাড়িয়েছি। বাড়তি মূল্যের কারণে আমাদের কৃষকদের সেই তেল কিনে খাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মতো কৃষকদের জমিতে আবাদের ওপরেই সব কিছু নির্ভর করে। তাই আমি পরিবারের তেলের চাহিদা মেটাতে প্রতিবারই সরিষার আবাদ করে আসছিলাম। কিন্তু সেই তুলনায় এবারে আবাদের পরিমাণ একটু বেশি। গত বছর দুই বিঘা জমিতে সরিষার চাষাবাদ করলেও এবারে ৫ বিঘা জমিতে করেছি। গত বছর আবহাওয়া ভালো না থাকায় সরিষার ফলন ভালো হয়নি। এবারে আবহাওয়া বেশ ভালো রয়েছে। তাতে এবারে সরিষার ভালো ফলন হবে বলে আশা করছি। সরিষার যে গাছ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে করে এবারে বিঘাপ্রতি ৬ থেকে ৭ মণ করে ফলন হবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’
হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, ‘চলতি রবি মৌসুমে উপজেলায় দুই হাজর ৯৫৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর বিপরীতে আমরা ৩ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ করতে সক্ষম হয়েছি। যা গত বছরের তুলনায় ৫৬৫ হেক্টর বেশি। সরকারি কৃষি প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় কৃষকদের মাঝে বিনা মূল্যে সরিষার বীজ ও সার বিতরণ করার ফলে কৃষকরা দিন দিন সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। চলতি মৌসুমে উপজেলার তিন হাজার ২০০ জন কৃষকের মাঝে বিনা মূল্যে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। এরকম আবহাওয়া থাকলে আমরা প্রত্যাশা করছি যে, কৃষকরা সরিষার ভালো ফলন পাবেন। বোরো ও রোপা আমন মৌসুমের মধ্যবর্তী যে সময়টাতে জমিগুলো পতিত থাকে সেই পতিত জমির সর্বোত্তম ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হচ্ছে সেই সঙ্গে কৃষকরা একটি বাড়তি ফসল ঘরে তুলতে পারছেন ও লাভবান হচ্ছেন। আমাদের কৃষি বিভাগ থেকে প্রতিনিয়তই মাঠ পরিদর্শনসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। আমরা আশাবাদী, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছরও কৃষকরা সরিষার ভালো ফলন যেমন পাবেন তেমনি তারা লাভবান হবেন।’