চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলক চলাচল করছে যানবাহন। এরই মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সমালোচনা চলছে। একদল তরুণ মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছেন। গত শুক্রবার (৮ নভেম্বর) মধ্যরাতে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় নিহত হন দুই মোটরসাইকেল আরোহী মো. মোক্তার (২৮) ও মো. রুবেল হোসেন (৩৬)। তারা পেশায় ট্রাকচালক হলেও শখের বসে মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারনে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ দুর্ঘটনার সময় তাদের মোটরসাইকেলের গতি ছিল ১০০ কিলোমিটারের বেশি।
শুধু মোটরসাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা নয়, কেউ কেউ প্রাইভেটকার প্রতিযোগিতায় মেতেছেন। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হলেও, তা মানছেন না চালকরা। সেই সঙ্গে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ছিনতাইকারীর আনাগোনা। সবমিলিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়ার আগেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২৮ আগস্ট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। প্রায় ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে নেই প্রশাসনের নিরাপত্তাবলয়। ফলে রাত নামলেই এক্সপ্রেসওয়ে চলে যায় অপরাধীদের দখলে। যানবাহন চলাচলে মানা হচ্ছে না গতিসীমা। এ অবস্থায় যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে স্পিড ক্যামেরা লাগানোর কথা ভাবছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে যানবাহন চালালে তখন জরিমানা করা হবে।
দুর্ঘটনারোধে গাড়ির গতি কমানোর বিকল্প নেই বলে জানালেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট থেকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পরীক্ষামূলক যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। গাড়িগুলো লালখান বাজার হয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে ওঠানামা করতে পারছে। র্যাম্প নির্মাণের কাজ চলমান আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যানবাহন চলাচলের গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। তবে অনেকে তা মানছেন না। গত শুক্রবার দুর্ঘটনাকবলিত মোটরসাইকেলের গতি ছিল ১০০-১২০ কিলোমিটারের মধ্যে। বেপরোয়া গতির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে চালকদের সচেতন হতে হবে।’
এক্সপ্রেসওয়েতে সব লাইট বসানো সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘নতুন করে টোলের হার নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর টোল আদায়ে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। এরপর যানবাহন থেকে টোল আদায় করা হবে। বর্তমানে চলাচলকারী যানবাহন থেকে কোনও টোল আদায় করা হচ্ছে না।’
লালখান বাজার এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, ‘রাত নামলেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে তরুণদের মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এজন্য শুরুতেই ঘটছে দুর্ঘটনা। শুধু যে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা চলছে তা কিন্তু নয়, নানা কৌশলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র।
গত ২৬ অক্টোবর বিকালে এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট-আগ্রাবাদ অংশে দুর্বৃত্তের টানানো সুতার ফাঁদে পড়ে গুরুতর আহত হন সুজন তঞ্চঙ্গা নামের এক যুবক। সুজন বলেন, ‘আমরা দুজন এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে মোটরসাইকেলে পতেঙ্গায় যাচ্ছিলাম। চলন্ত অবস্থায় দেওয়ানহাট-আগ্রাবাদের মধ্যবর্তী অংশে আমার গলায় কিছু একটা আটকে যায়। একপ্রকার দম বন্ধ হয়ে আমার বাইকটি নিয়ে সড়কে পড়ে যাই। এতে আমার হাত-পাসহ পুরো শরীরে আঘাত পাই। নিচে পড়ে যাওয়ার পর ১৬-১৭ বছরের দুই কিশোর আমাদের দিকে আসছিল। তবে বিপরীত দিক থেকে আরও কয়েকটি গাড়ি আসার কারণে পেছনের দিকে চলে যায় তারা।’
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অপরাধীদের সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশানর (গণমাধ্যম) কামী মো. তারেক আজিজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি মাসে এক্সপ্রেসওয়েতে অভিযান চালিয়ে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রের ১১ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘৪ নভেম্বর রাতে এক্সপ্রেসওয়েতে অভিযান পরিচালনা করে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের তল্লাশি করে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে ডাকাতি-ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর কারণে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এখানে যানবাহন চালানোর সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। কেউ কেউ এই গতিসীমা না মেনে ১০০-১২০ কিলোমিটার গতিতে চালানোর চেষ্টা করছেন। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য এক্সপ্রেসওয়েতে স্পিড নিয়ন্ত্রণ ক্যামেরা লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত গতিসীমার বেশিতে চালালে ওই গাড়ি অটোমেটিক জরিমানার আওতায় আসবে। তবে স্পিড নিয়ন্ত্রণ ক্যামেরা বসানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি।’
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নগরের লালখানবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫৪ ফুট প্রস্থের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। পরে তা পরিবর্তন করে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। বর্তমানে আরও এক বছর সময় বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এত বছরেও নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় এর সুফল পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে একনেকে প্রকল্পটি অনুমোদন হওয়ার সময় তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণকাজের উদ্বোধন হলেও ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে নকশা সংশোধন করে আরও এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় সর্বশেষ প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ পুরো শেষ করা যাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে।