খুলনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পুলিশ কনস্টেবল সুমন কুমার ঘরামীর পরিবারের সদস্যদের কান্না কিছুতেই থামছে না। বাবাকে বারবার খুঁজছে তার ছয় বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে স্নিগ্ধা। আর স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আহাজারি করছেন স্ত্রী মিতু বিশ্বাস।
শনিবার (৩ আগস্ট) সুমনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অনবরত কাঁদছেন পরিবারের সদস্যরা। স্ত্রী মিতু বিশ্বাস কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে গেলো, আমার বেঁচে থাকার আর ঠিকানা রইলো না। এই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে কীভাবে আমি বাঁচবো। কী হবে আমাদের ভবিষ্যতের। কিছুই জানি না।’
এর আগে শুক্রবার (২ আগস্ট) রাতে স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনা সিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান মিতু। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তা, আত্মীয়-স্বজন যাকেই পেয়েছেন তাকে জড়িয়ে ধরে, পায়ে ধরে স্বামীকে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি জানান। তার আহাজারি দেখে চোখে পানি ধরে রাখতে পারছেন না কেউই। রাতে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক ও খুলনা রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি মঈনুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হাসপাতালে গিয়ে সান্ত্বনা দেন তাদের। কিন্তু কোনও সান্ত্বনাতেই শান্ত হতে পারেননি মিতু।
জানা গেছে, বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার সুমন ঘরামি স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে নগরীর বয়রা এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সোনাডাঙ্গা জোনের সহকারী কমিশনার সৌমেন বিশ্বাসের দেহরক্ষী ছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় খুলনার মোহাম্মদনগর এলাকায় আন্দোলনকারীদের পিটুনিতে নিহত হন।
সহকারী কমিশনার সৌমেন বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ও সুমন একসঙ্গে ছিলাম। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আমরা দলছুট হয়ে যাই। প্রাণ বাঁচাতে ইউনিফর্ম খুলে প্রায় ৪ ঘণ্টা ড্রেনের মধ্যে ছিলাম আমি। এর কোনও একসময় আন্দোলনকারীরা কনস্টেবল সুমনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে।’
এ বিষয়ে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের হামলায় পুলিশ সদস্য সুমন নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে আরও কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।’
একমাত্র ছেলে পুলিশ কনস্টেবল সুমন ঘরামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে নির্বাক বসেছিলেন বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সুশীল কুমার ঘরামি। পাশে বসে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে বিলাপ করছেন মা গীতা রানি। বীর নিবাসের অন্য কক্ষের মেঝেতে লুটিয়ে কান্না করছেন একমাত্র বোন সুমা ঘরামি। পাশে বসে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশী ও স্বজনরা। আর ঘরের সামনে সিমেন্ট-বালু ও ইট দিয়ে সমাধি তৈরি করে অপেক্ষা মরদেহের অপেক্ষা করছেন স্থানীয়রা। শনিবার বিকেল ৫টায় বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কিসমত মালিপাটন গ্রামের সুমনের বাড়ির দৃশ্য এমনই ছিল।
প্রতিবেশীরা জানান, তিনবার স্ট্রোক করেছেন সুমনের বাবা। শারীরিকভাবে অসুস্থ। ছেলের মৃত্যুর খবর এ নির্বাক হয়ে গেছেন। কোনও কথা বলছেন না। মাঝে মাঝে শুধু বলছেন, ছেলে হত্যার বিচার চাই।
সুমনের মা গীতা রানি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘এত ছবি তুলে কী হবে, আমার ছেলেকে কি ফিরিয়ে দিতে পারবা? তোমরা এত ছবি তুলছো কেন?’
মেঝেতে লুটিয়ে কান্না করতে করতে সুমনের একমাত্র বোন সুমা ঘরামি বলেন, ‘কারা মারলো আমার ভাইকে। আমাদের পরিবারকে ধ্বংস করে দিলো। কে চালাবে আমাদের এখন?’
প্রতিবেশী ও সুমনের বন্ধু সমর কৃষ্ণ ঘরামি বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে এসএসসি পাস করছি। এরপর সে এইচএসসি পাস করে। এর কিছুদিন পর পুলিশে যোগদান করেন সুমন কুমার ঘরামি।’
রফিকুল ইসলাম নামের সুমনের এক সহপাঠী বলেন, ‘সুমন অনেক ভালো মানুষ ছিল। সে সব সময় শ্রেণিকক্ষ মাতিয়ে রাখত। তার মৃত্যুতে আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছি।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যুই কষ্টের।’ যারা সুমনকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার দাবি করেন তিনি।
পুলিশ লাইন্সে সুমনের শ্বশুর নবীন বিশ্বাস বলেন, ‘একমাত্র নাতনী ছয় বছরের স্নিগ্ধা সারা রাত কেঁদেছে। কিছুক্ষণ পর পর বাবা বাবা বলে চিৎকার করছে। সুমনের আদরের ধন ছিল স্নিগ্ধা। ওকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। আজ সব শেষ হয়ে গেল, ওর ভবিষ্যৎ কী হবে?’
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল সুমনের হত্যাকারীদের বিচার করা হবে। সে লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত ও আইনের আওতায় আনা হবে।’
তিনি বলেন, ‘শনিবার বিকালে পরিবারের সদস্যদের কাছে সুমনের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার সরদার রকিবুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুনসহ পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।’
পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘নিহতের পরিবারকে তাৎক্ষণিক ১ লাখ টাকা এবং মরদেহ সৎকারে আরও ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে ৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র এবং নগদ ২ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্য করা হবে। সুমনের পরিবারে পুলিশে চাকরির উপযোগী কেউ থাকলে তাকে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। কেএমপি আজীবন পরিবারটির পাশে থাকবে।’
এদিকে শনিবার বিকালে ময়নাতদন্তের পর পুলিশ লাইন্সে গার্ড অব অনার শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ। পরিবারের সদস্য ও পুলিশ সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন এসময়, পরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাগেরহাটের কচুয়ায়। সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
শনিবার বিকাল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মৃতদেহ পৌঁছায় সুমনের বাড়িতে। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজন ও স্থানীয়রা। এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয় সুমনের বাড়ির সামনে। পরে সেখানে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সুমনকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। গার্ড অব অনার শেষে সুমনের নিথর দেহ নেওয়া ঘরের বারান্দায়। সেখানে বাবা-মা-বোন, স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা সুমনের মরদেহ শেষ বারের মতো দেখেন। পরে সন্ধ্যায় নিজ ঘরের সামনে সুমনকে সমাহিত করা হয়। সুমনের বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ছেলেকে দাহ না করে মাটি চাপা দেওয়া হয়।
সুমনকে গার্ড অব অনার দেওয়া ও সমাহিত করার সময়, বাগেরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাসুদ রানা, কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বাবু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাখী ব্যানার্জী, কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহসিন হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।