হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের ঘটনায় আজও আতঙ্কিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষ। এক বছর পূর্ণ হলেও ঘটনার ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। এ ঘটনায় ৫৫টি মামলা হয়েছিল। এরমধ্যে একটিরও চার্জশিট দিতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পর যারা পুলিশি অভিযানে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছেন। এ নিয়ে সচেতন মহলে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
পুলিশের ভাষ্য, প্রতিটি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেবে। তবে কবে নাগাদ চার্জশিট দেবে, তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি পুলিশ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাদ্রাসার ছাত্রদের ওপর পুলিশের হামলার খবরে ২০২১ সালের ২৬ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্যাপক তাণ্ডব চালায় হেফাজতের ইসলামের কয়েক হাজার নেতাকর্মী।
এ সময় শহরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে তারা। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে মিছিল নিয়ে শহরের রেলস্টেশন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, আনন্দময়ী কালীমন্দির, উপজেলা ভূমি অফিস, সরকারি গণগ্রন্থাগার, পৌরসভা ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, মৎস্য ভবন, সিভিল সার্জন কার্যালয়, সার্কিট হাউজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের অফিস ও বাসভবন, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভনের বাড়িসহ অর্ধশতাধিক স্থাপনা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ঘটনার এক বছরে সাত শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলেও অধিকাংশ জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। তবে ঘটনার নেপথ্যের ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।
আবরণী আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক শারমিন সুলতানা বলেন, ‘গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতের ইসলামের কয়েক হাজার নেতাকর্মী যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তার বিচার হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও শিল্প স্থাপনাগুলো বেছে বেছে আক্রমণ করা হয়েছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরসহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগুন দিয়েছিল তারা। অবাক লাগে, ঘটনায় জড়িতদের এখনও শাস্তি হয়নি। একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তাদের বিচার চাই।’
জেলা জাসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার হোসেন সাঈদ বলেন, ‘স্বাধীনতা দিবসে গত বছর হেফাজতে ইসলাম যে তাণ্ডব চালিয়েছিল, আমরা তা ঘৃণা করি। তাদের যে ধরনের বিচার হওয়ার কথা ছিল তা দেখতে পাইনি। এখানে কোনও পক্ষের আপস আছে বলে আমাদের সন্দেহ। যতদিন তাদের বিচারের আওতায় না আনা হবে ততদিন স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব না। তাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করার আহ্বান জানাই।’
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দীপক চৌধুরী বাপ্পী বলেন, ‘গত ২৬ থেকে ২৮ মার্চ হেফাজতের নেতাকর্মীরা পুরো শহরে তাণ্ডব চালিয়েছিল। শহরের রেলস্টেশন, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান মন্দির আনন্দময়ী কালিমন্দির, উপজেলা ভূমি অফিস, সরকারি গণগ্রন্থাগার সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছিল তারা। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে আমরা পড়েছি। তাদের বিচার না হওয়ায় ঘটনাগুলো বারবার ঘটছে। সরকারের উচিত সব সংগীতাঙ্গন রক্ষা করা। পাশাপাশি যারা সেদিন তাণ্ডব চালিয়েছিল তাদের দ্রুত বিচার করা।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. নাজমুল হোসেন বলেন, সব মামলা তদন্তাধীন আছে। জাতি চায় এ ঘটনার বিচার হোক। একজন আইনজীবী হিসেবে তাদের বিচার চাই এবং বিচার হবেই। বাংলাদেশে কোনও মানুষ অপরাধ করে পার পেয়ে যায়নি। তবে গ্রেফতারকৃত আসামিরা জামিন পেলেও হামলাকারীরা বিনা বিচারে পার পাবে না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, তাণ্ডবের ঘটনায় ৫৫টি মামলা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৭৫৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরমধ্যে ৬৩৮ জন আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে গেছেন। ১২০ জন এখনও কারাগারে আছেন। আমরা মামলাগুলো তদন্ত করছি। এখন পর্যন্ত কোনও মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ হলেই মামলাগুলোর চার্জশিট আদালতে জমা দেবো।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানায় ৪৯টি, এরমধ্যে জেলা পুলিশের তদন্তাধীন ৩৬টি মামলায় ৪৯ আসামি ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আশুগঞ্জ থানায় চারটি, সরাইল থানায় দুটিসহ জেলায় সব মিলিয়ে ৫৫টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৭৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে ৬৩৮ জন জামিন পেয়েছে।