দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতীয় পূর্ববাংলার অনেক সৈনিক রেখেছিলেন বীরত্বপূর্ণ অবদান। তাদের কয়েকজন স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেছেন বাংলা ট্রিবিউন-এর কাছে। ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্বে আজ রইলো ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নানের গল্প।
কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার আজলদী গ্রামের একটি মসজিদের সামনে দেখা গেলো এক বৃদ্ধ লাঠি হাতে বসে আছেন। জানতে চাইলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সৈনিক আব্দুল মান্নানকে চেনেন? কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন— আমিই সেই সৈনিক। একগাল হেসে প্রতিবেদককে হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে বসালেন। ট্রাংক থেকে বের করতে শুরু করলেন স্মৃতির ঝাঁপি।
যুদ্ধের সময়কার কিছু কাগজপত্র ও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠি বের করে দেখালেন আব্দুল মান্নান। বের করলেন যুদ্ধকালীন পোশাকও। ছবি ওঠাতে চাইলে বললেন— বাবা, পোশাকটা গায়ে দিয়ে নিই।
পোশাকের পকেটে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন র্যাংক মেডাল ঝুলছে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া আব্দুল মান্নানের বয়স ১০৭ বছর হলেও, তিনি দাবি করেন তার বয়স ১১৫ বছরের কম নয়।
চেহারায় বয়সের ছাপ থাকলেও এখনও চলাফেরা ও কথাবার্তায় বেশ সাবলীল। জানালেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি কখনও। অবাক করা বিষয় হলো, কখনও বিদ্যালয়ে পা না রাখলেও আব্দুল মান্নান ইংরেজিও বলতে পারেন। জানালেন, ইংরেজদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউন: কীভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিলেন?
আব্দুল মান্নান: ১৯৪২ সাল। বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিতে লাইনে দাঁড়ালাম। এক ব্রিটিশ অফিসার এসে জোরে থাপ্পড় মারতে লাগলেন সবার বুকে। থাপ্পড় খেয়ে অনেকে মাটিতে পড়ে গেলেও আমি সটান দাঁড়িয়ে ছিলাম।
ট্রেনিংয়ের জন্য পাকিস্তান ও চীনের সীমান্ত এলাকা হাসানাবাদ বর্ডারকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে একমাস ট্রেনিংয়ের পর ব্যাটালিয়ন ক্যাপ্টেন ড. গলিব আমাকে বললেন, তোমাকে ল্যান্স নায়েকের দায়িত্ব নিতে হবে।
আমরা চার হাজার সৈনিক পানিপথে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। ছয় মাসের খাবার মজুত নিয়ে আমাদের জাহাজ রওনা দেয় কলম্বোর দিকে। বিরাট বড় জাহাজ। অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ চারটা কামান বিভিন্ন দিকে তাক করা। টানা একমাস রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজটি আমাদেরকে নিয়ে ঘুরলো।
আমাদের বলা হলো— পানিপথে অনেকেই আক্রমণ করতে আসবে। তাদের যেন গুলি করে হত্যা করা হয়।
একমাস পর আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আবার কলম্বোয় ফিরলাম। কলম্বোর কাছাকাছি হিটলারের একটি জাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে হায়দ্রাবাদ নিয়ে আসা হলো আমাদের।
১৫ দিনের ছুটি দেওয়া হয়। ছুটি শেষে আবারও জয়েন করার পর করাচি থেকে মিয়ানমারের দিকে রওনা হলাম আমরা।
প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে হিমালয়ের নিচ দিয়ে মিয়ানমার পৌঁছলাম। মিয়ানমার এসে ক্যাম্প করার পর হিরোশিমায় বোমা ফেলার সংবাদ পাই আমরা।
বাংলা ট্রিবিউন: যুদ্ধে কতজন শত্রুকে হত্যা করেছেন?
আব্দুল মান্নান: আমি একজনকেও করিনি। এ ধরনের পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়নি আমাকে। ট্রেনিংয়ের সময় আমাদের চারটি জিনিস বলে দেওয়া হয়েছিল— কাউকে থাপ্পড় দেওয়া যাবে না, সম্পদ লুট করা যাবে না, নারীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো যাবে না এবং মিথ্যা বলা যাবে না।
আমি চালাতাম হালকা মেশিন গান। কাঁধে অস্ত্র নিয়ে প্রতিদিন স্থল পথে ছয় মাইলের মতো এগোতে হতো আমাকে। হিরোশিমায় বোমা মারার পর ইন্ডিয়ানদের কাছে আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে ব্রিটিশরা চলে যেতে থাকে।
পাঁচ-সাত জন করে একেকটি দল ক্যাম্প ছেড়ে দিতে থাকে। আমরা বিভিন্নভাবে জানতে চাই— ব্রিটিশরা আমাদেরকে রেখে কোথায় যায়। উত্তরে ইন্ডিয়ানরা জানায়— তারা কোয়ার্টারে যায়। সত্যিটা হলো সব ব্রিটিশ তখন আমাদেরকে ক্যাম্পে রেখেই ফ্লাইটে করে লন্ডন চলে যাচ্ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে দেখি একজনও সাদা চামড়ার অফিসার নেই। হিরোশিমায় বোমা মারার পর যুদ্ধটা আসলে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে আবার হায়দ্রাবাদে নিয়ে আসা হলো আমাদের। পাঁচশ টাকা হাতে ধরিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো আমাকে।
বাংলা ট্রিবিউন: কী পেলেন ওই যুদ্ধে গিয়ে?
আব্দুল মান্নান: তেমন কিছু পাইনি। এরশাদের আমলে আমি ব্রিটেনের রানির কাছে চিঠি লিখি। তাতে লিখেছিলাম— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু আপনার ব্রিটিশ সেনাবাহিনী আমাদের ফেলে কমান্ড ছেড়ে চলে গেলো। যুদ্ধ জয় করে আপনার দেশের সৈন্যরা আমাদের কাছে কিছু না বলে চুপিচুপি চলে গেলো। এখন লন্ডন শহরে তারা মাথা উঁচু করে হাঁটে। আমি যে আপনাদের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিলাম আমাদেরকে তো প্রাপ্য সম্মানটুকু দেননি। কোনও খোঁজ-খবরও রাখেননি। চিঠির একটি কপি দিলাম রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও আরেকটি ব্রিটিশ হাইকমিশনে। সেখান থেকে ব্রিটিশ রানি আমার চিঠির উত্তর দিলেন। চিঠিতে জানালেন— আপনার বিষয়টি দেখার জন্য আমাদের তরফ থেকে আপনাদের রাষ্ট্রপতি এরশাদকে বলা হয়েছে। ব্রিটিশ অ্যাম্বাসি থেকে আমাকে চিঠি দেওয়া হলো— আপনার বিষয়টি ব্রিটিশ সোলজার বোর্ড থেকে অচিরেই সমাধান করা হবে।
ময়মনসিংহের কাচারীঘাট সোলজার বোর্ড থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা দেওয়া হলো সে সময়। এরশাদ গ্রেফতার হওয়ার পর ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। এখন কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছি।
বাংলা ট্রিবিউন: পরিবার নিয়ে কেমন আছেন?
আব্দুল মান্নান: ভালো আছি। তেমন অসুখ-বিসুখ নেই আমার। ছয় ছেলে, পাঁচ মেয়ে। সবাই ভালো আছে। আমার পাঁচ স্ত্রীর মধ্যে এখন দুজন বেঁচে আছে। সব পক্ষ মিলিয়ে মোট ১১ জন সন্তান।