৯ বছর আগে এই দিনে মিরপুরে নিজ বাসার কাছে জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে খুন হয়েছিলেন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। নৃশংস ওই খুনের ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারপ্রক্রিয়ার সবগুলো ধাপ এখনো শেষ হয়নি। রাজীবকে খুনের দায়ে বিচারিক কোর্টে দুজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, সেটি হাইকোর্টেও বহাল থাকে। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য বর্তমানে মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
২০১৩ সালের রাজীব খুনের পর তিন বছরের ব্যবধানে জঙ্গিদের হাতে একে একে খুন হন আরও সাতজন লেখক, ব্লগার, প্রকাশক ও অধিকারকর্মী। এসব খুনের মামলারও বিচারপ্রক্রিয়ার সবগুলো ধাপ এখনো শেষ হয়নি। লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, ইউএসএআইডির কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী খুনের মামলায় বিচারিক আদালতে রায় হয়েছে। তবে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ও নাজিম উদ্দিন হত্যার বিচারের প্রাথমিক ধাপও এখনো শেষ হয়নি। মামলাগুলো ঢাকার আদালতে বিচারাধীন। মতপ্রকাশের জন্য জঙ্গিদের হাতে খুনের এসব ঘটনার মামলার বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে পরিবারগুলোর মধ্যে একধরনের অসন্তোষ রয়েছে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও অধিকারকর্মীদের চাঞ্চল্যকর এসব খুনের মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর রয়েছে। ব্লগার রাজীব হায়দারসহ কয়েকটি মামলায় বিচারিক কোর্টে রায় শেষ হয়েছে। এসব মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
হত্যাকাণ্ডের ৭ থেকে ৯ বছর পরও যখন বিচারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হয়, সে ক্ষেত্রে মানুষ বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। এই অবস্থা দেশের আইনের শাসন রক্ষা করার পরিপন্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক
বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল করার সুযোগ থাকে। ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়।
ব্লগার রাজীব হায়দারের বাবা চিকিৎসক নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেবল লেখালেখির জন্য দেশের জঙ্গিরা আমার নিরপরাধ ছেলেকে খুন করে ফেলল। নিম্ন আদালতে দুজনের ফাঁসির রায় হলে তা আজও কার্যকর হয়নি। কবে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হবে, কবে রায় কার্যকর হবে, তা জানি না।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেবল মতপ্রকাশের জন্য তিন বছরের ব্যবধানে জঙ্গিদের হাতে এতগুলো মানুষের খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা ভয়ংকর, যা মুক্তচিন্তার জন্য অশনিসংকেত, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যত দ্রুত সম্ভব বিচারপ্রক্রিয়া শেষে রায় কার্যকর করা উচিত।
জিয়া-আকরাম যখন হুমকির বড় কারণ
সাতটি খুনের মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুটি হত্যাকাণ্ড বাদে (ব্লগার রাজীব ও ওয়াশিকুর) অপর পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেনের নাম এসেছে।
আর বিচারিক আদালতে তা প্রমাণিত হওয়ায় ব্লগার অভিজিৎ ভট্টাচার্য, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন, জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী হত্যায় জিয়াউল হক ও আকরামের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত তাঁদের নাগাল পায়নি। সম্প্রতি জঙ্গি জিয়া ও আকরামের সন্ধান দিলে মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জিয়া কিংবা আকরাম দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গা ঢাকা দিয়েছেন।
তিন খুনের বিচার এখনো প্রাথমিক ধাপে
রাজীব খুনের দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন লেখক অভিজিৎ রায়। ওই মামলায় গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি জিয়াউলসহ পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড দেন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। আর ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে খুন হন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। এই খুনের দায়ে ছয়জনের মৃত্যু দেন আদালত। আর ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে খুন হন জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বী। এই জোড়া খুনের দায়ে জিয়াউলসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এই তিনটি মামলাই এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। তবে সাত বছর আগে (২০১৫ সালের ৩০ মার্চ) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে খুন হন ওয়াশিকুর রহমান। এই খুনের বিচার এখনো শেষ হয়নি। এ ছাড়া ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খুন হন আরেক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। এই খুনের দায়ে জিয়াউলসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
আর ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকার রাস্তায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিম উদ্দিন। মামলাটি এখন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
মতপ্রকাশ ও লেখালেখির জন্য হত্যাকাণ্ডের কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারপ্রক্রিয়া নিষ্পত্তি না হওয়া নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের ৭ থেকে ৯ বছর পরও যখন বিচারের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হয়, সে ক্ষেত্রে মানুষ বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারায়। এই অবস্থা দেশের আইনের শাসন রক্ষা করার পরিপন্থী।’