ভবিষ্যতে আম্পান কিংবা ইয়াসের চেয়েও শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা যত বাড়বে, ততই বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা। ঘূর্ণিঝড়গুলো বর্তমানে আগের চেয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে উপকূলের দিকে আসছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যার খুব বেশি পরিবর্তন না হলেও শক্তি বাড়বে বলে জানাচ্ছেন আবহাওয়াবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ের ঘূর্ণিঝড়গুলোর উচ্চ গতিবেগ, রেকর্ডভাঙা বৃষ্টিপাত, চলার পথের মন্থর গতিবেগ, স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জলোচ্ছ্বাস, উপকূলের কাছে এসে হঠাৎ মন্থর হয়ে যাওয়া ও হঠাৎ শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। এ অবস্থায় উপকূলে সুন্দরবন রক্ষা, টেকসই বেড়িবাঁধ, দুর্যোগ সহনীয় বাড়িঘর ও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরকে আরও আধুনিকায়ন করার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাত থেকে এ যাত্রায় বাংলাদেশের উপকূল রক্ষা পেলেও জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ভারতের ওডিশা রাজ্যের উত্তরের উপকূল লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গতকাল বুধবার বিকেলে দুর্বল হয়ে পড়েছে ইয়াস। আরও শক্তিক্ষয়ের পর গভীর নিম্নচাপে পরিণত হবে এ ঘূর্ণিঝড়।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন যত বাড়বে, ততই বাড়বে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা, যাতে আরও ঝুঁকিতে পড়বে উপকূল। উষ্ণায়নের জেরে শুধু ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগই বাড়বে না, বাড়বে বৃষ্টির পরিমাণও। ধীরে ধীরে ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রের গতি কমছে বলেও দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে দীর্ঘ সময় সমুদ্রের ওপর থাকছে ঝড়। শোষণ করছে বেশি শক্তি।
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর প্রায় এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার ও ২০০৯ সালে আইলা প্রায় ৯০০ কিমিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে আঘাত হানে। আর ফণী ভারত মহাসাগরে সৃষ্টি হওয়ার পর দুই হাজার কিমিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ওডিশা উপকূলে আঘাত হানে। এবার ঘূর্ণিঝড় ইয়াস নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর ৭০০ কিমিলোমিটার পাড়ি দিয়ে স্থলভাগে আঘাত হেনেছে বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।
ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় শক্তিশালী হয়ে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই গবেষক বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হতে হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা যদি ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে বেশি হয়, তবে পানির স্তরের গভীরতা যত বেশি হবে, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য তত বেশি পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় হতে থাকবে বলে গণ্য করা হয়। আবহাওয়াবিদ্যার ভাষায় যাকে মহাসাগরীয় তাপীয় পরিমাণ বলা হয়। বঙ্গোপসাগর অপেক্ষাকৃত অগভীর সমুদ্র, ফলে এর সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বছরের একটি উল্লেখযোগ্য সময়ে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের ওপর থাকে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কিংবা তার চেয়ে বেশি হতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় মৌসুম দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কার কথা নির্দেশ করছে জলবায়ু পূর্বাভাস মডেলগুলো।’
বাংলাদেশ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর দিক দিয়ে বেশ সাফল্য পেলেও কিছু অব্যবস্থাপনার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) চলতি বছরের এক প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, বন্যা মোকাবিলায় এ দেশে আট হাজার ২০০ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং তিন হাজার ৪০০ কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় দুই হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র এবং ২০০ বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু এসব অবকাঠামো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে।
এবার বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আঘাত না হানলেও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধ ভেঙে গেছে। লোনা জলে প্লাবিত হয়েছে বসতবাড়ি ও কৃষিজমি। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ দেশের উপকূলের বাঁধগুলোর অবস্থা যে শোচনীয়, তা কারও অজানা নয়। এত ঘূর্ণিঝড়ের পরও বাঁধগুলোর হাল ফিরল না কেন- এমন প্রশ্নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘যে বাঁধগুলো আছে সেগুলো ষাটের দশকের। এগুলো সংস্কার করলেও খুব একটা লাভ হবে না।’
অতীতে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও সুরক্ষাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল সুন্দরবন। কিন্তু সেই রক্ষাকবচও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর মানুষের কারণে ক্ষতির শিকার। পরিবেশবাদীরা এর সুরক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেন। পরিবেশবিদ মিহির বিশ্বাস বলেন, সুন্দরবনে গাছ কাটা, পোড়ানো, মানুষের বিচরণ, জাল ও নৌকার আঘাতে শ্যাওলা-গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ক্ষতি হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই সুন্দরবনে বিচরণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।