সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ও শোভনালী ইউনিয়নের মরিচ্চাপ নদীর ওপর নির্মিত সেতুটি দুই বছর ধরে ভেঙে পড়ে আছে। এতে উপজেলা শহরের সঙ্গে সেতুর দুই পাশের চার ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। ভাঙা সেতু দিয়ে মাসের পর মাস চলাচল করছেন স্থানীয় লোকজন। ইতিমধ্যে নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় চলাচলে ভোগান্তিতে পড়েছেন এখানকার চার লক্ষাধিক বাসিন্দা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার মরিচ্চাপ নদীর ওপর সাত বছর আগে কুন্দুড়িয়া-বাঁকড়া সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ২০২২ সালের ৪ জুলাই সেতুর মাঝ বরাবর ভেঙে দেবে যায়। এরই মধ্যে কেটে গেছে দুই বছর দুই মাস। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে জোয়ারের পানিতে সেতু দিয়ে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় স্থানীয়দের। এখন অতিবৃষ্টির কারণে পানিতে তলিয়ে গেছে সেতুটি। এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে পানি মাড়িয়ে চলাচল করছেন চার ইউনিয়নের চার লক্ষাধিক মানুষজন।
আশাশুনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলছেন, সেতু লাগোয়া সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি)। সে হিসেবে ভেঙে যাওয়া সেতুটি সংস্কার কিংবা নির্মাণ করবে এলজিইডি।
তবে এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলী বলছেন, কুন্দুড়িয়া-বাঁকড়া সড়কটি এলজিইডির। কিন্তু সেতুটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় নির্মাণ করেছিল। কাজেই সংস্কারের ব্যাপারে ওই মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারি এই দফতরগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে সাধারণ মানুষ পড়েছেন বিপাকে। প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ভাঙা সেতু দিয়ে পার হচ্ছেন এলাকার শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এলাকাবাসী জানান, সেতু নির্মাণের আগে মরিচ্চাপ নদীটি আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ও শোভনালী ইউনিয়নকে বিভক্ত করে রেখেছিল। ডিঙি নৌকা দিয়ে নদী পার হয়ে মানুষ আশাশুনি সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করতেন। কোনও খেয়া নৌকা কিংবা ঘাট না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হতো। তাদের দাবির মুখে বুধহাটা ইউনিয়নের দক্ষিণে কুন্দুড়িয়া ও শোভনালী ইউনিয়নের উত্তরে বাঁকড়াকে সংযুক্ত করে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২ সালের ৪ জুলাই সেতুটির মাঝ ভেঙে দেবে যায়। এরপর থেকে দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করতে হয় তাদের।
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৫৪ লাখ চার হাজার ৬৫০ টাকায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণ করা হয়। মরিচ্চাপ নদী খননের পর প্রস্থ বেড়ে যাওয়ায় এটি ভেঙে দেবে যায়। বর্তমানে সেতুর মাঝ বরাবর পানিতে ডুবে গেছে। দুই পাশের পলেস্তারা খসে পড়েছে, রডে ধরেছে মরিচা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, সেতুটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন দুই পাশে কাঁচা সড়ক ছিল। নদীটিও ভরাট হয়ে ছোট হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওই সড়কটি এলজিইডি পাকা করার পাশাপাশি তাদের তালিকাভুক্ত করে নিয়েছে। তবে সেতু সংস্কার করেনি তারা।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর ভাষ্যমতে, ২০১৬ সালে সেতুটি নির্মাণ করেছিল ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। পাকা করার অনেক আগে থেকেই এটি এলজিইডির সড়ক। তখন যেহেতু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় স্থানীয় প্রকল্প কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমে সেতু নির্মাণ করেছিল, তাদেরই সেতুটি সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করার কথা। এরপরও জনসাধারণের ভোগান্তির কথা বিবেচনা নিয়ে এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী। কিন্তু তারপর আর কোনও নির্দেশনা আসেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন সাতক্ষীরার ফিংড়ি, আশাশুনির বুধহাটা ও সোভনালী এবং কালিগঞ্জের চাম্পাফুল ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় চার লাখ মানুষ এই সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু মাঝখানের বড় অংশ ভেঙে যাওয়ায় লোকজনকে এখন ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয়।
শোভনালী ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুর রউফ বলেন, সেতুটি মাঝ বরাবর ভেঙে গেছে। এখন সেতুর ওপর দিয়ে নদীর জোয়ারের পানি প্রবাহিত হয়। ফলে জোয়ারের সময় পুরুষরা কোনও রকমে পারাপার হন। কিন্তু নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা পড়েন বিপাকে। একইসঙ্গে এলাকার শিক্ষার্থীরাও ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হয়।
কুন্দুড়িয়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিব জানায়, তারা নদীর অপর পাড়ের গ্রাম থেকে বাইসাইকেলে স্কুলে যাতায়াত করে। কিন্তু সেতুর ওপর পানি থাকলে সাইকেলে পারাপার করতে পারে না। সাইকেল পারাপারের জন্য প্রতিবার ১০ টাকা করে দিতে হয়। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। ভাঙা সেতুর কারণে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে খুব কষ্ট হয় তাদের।
কুন্দুড়িয়া হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক রঘুনাথ কুমার বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ এই সেতু পারাপার হন। সংস্কার কিংবা নির্মাণ না হওয়ায় দুর্ভোগের শেষ নেই এই অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষের। এটি দ্রুত পুনরায় নির্মাণ কিংবা সংস্কারের দাবি জানাই।
কুন্দুড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী আসে বাঁকড়ার অপর পাড় থেকে। প্রতিদিন কয়েকশ ছেলেমেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সেতু পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। সংস্কার না হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। এটি দ্রুত সংস্কার করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপজেলা এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, সেতুটি আমাদের নয়। এর জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভেঙে পড়া সেতুটি যদি তারা অপসারণ করে, তাহলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এখানে নতুন সেতু করার চাহিদাপত্র পাঠাতে পারবো।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. সোহাগ খান জানিয়েছেন, সেতুটি আমাদের অধিদফতর কর্তৃক নির্মাণ করা হলেও এখন সেতুর দুই পাশে এলজিইডির রাস্তা হওয়ায় এটার দায়-দায়িত্ব এলজিইডির।