ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ পাঠানো অসম্ভব, বলছেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ

ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ পাঠানো অসম্ভব, বলছেন চাঁদপুরের ব্যবসায়ীরা

ইলিশের বাড়িখ্যাত চাঁদপুরে এ বছর ইলিশ মাছের আমদানি তলানিতে। গত বছরের এই সময়ে প্রতিদিন চাঁদপুরের বাজারে কয়েক হাজার মণ আমদানি হলেও, তা এখন কয়েকশ মণে ঠেকেছে। এরই মধ্যে আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির ঘোষণা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ এই ইলিশ ‘চাঁদপুর ঘাটের একদিনেরও না’ বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশের এত কম আমদানির মধ্যে চাঁদপুর থেকে ভারতে এত টন ইলিশ রফতানি করা একেবারেই অসম্ভব। কারণ এবার বাজারে মাছের সরবরাহ অনেক কম।

ইতোমধ্যে ভারতে রফতানির খবরে ইলিশের দাম আরও বেড়ে গেছে। তাই মধ্য ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে জাতীয় এই মাছ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানির খবর চাউর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকারভেদে মণপ্রতি আট-১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। চলে গেছে মানুষের নাগালের বাইরে।

চাঁদপুর বড়স্টেশন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ঘুরে দেখা গেছে, বুধবার আড়তের ঘাটে একটি ফিশিং বোট এসেছে। ছোট নৌকাযোগেও আসছে ইলিশ ও অন্যান্য মাছ। সড়কপথে পিকআপ ও মাঝারি ট্রাকে আসা ইলিশ নামানো হচ্ছে আড়তে। তবে গত সপ্তাহের তুলনায় সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। ডাক তুলে চলছে বেচাকেনা। ঢাকা-কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর ক্রেতা-বিক্রেতা মাছ কিনতে এসেছেন।

কুমিল্লা থেকে বড়স্টেশন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ কিনতে এসেছেন আতাউর রহমান। দাম কেমন চলছে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চাঁদপুরে ইলিশ কিনতে এসে দেখলাম দাম অনেক বেশি। এত দাম হলে সাধারণ মানুষ ইলিশ খেতে পারবে না। আমরা চাই এই মাছের দাম আরও কমে আসুক। এক কেজি ওজনের মাছের দাম এক হাজার ৮০০ টাকা চাইছেন ব্যবসায়ীরা। এর চেয়ে একটু বেশি ওজনের প্রতি কেজির দাম চেয়েছেন দুই হাজার ২০০ টাকা। একটা কথা আছে, কাউতলায় কাউয়ের দাম বেশি, এখানেও তাই।’

চৌদ্দগ্রাম থেকে মাছ কিনতে আসা প্রবাসী পলাশ আহমেদ বলেন, ‘বাজারে ইলিশের যে দাম দেখছি, তা সাধারণ মানুষ কিনে খাওয়ার মতো নয়। চাঁদপুরে এক কেজি ওজনের ইলিশ এক হাজার ৮০০ টাকায় খুচরায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ আমরা শুনেছিলাম, ভারতে মাছ যাচ্ছে না এজন্য দাম কম। সরেজমিনে এসে দেখছি ভারতে মাছ যাচ্ছে। এজন্য দাম অনেক চড়া। ব্যবসায়ীরা বলছেন পূজার পর নাকি দাম কিছুটা কমবে।’

ঢাকা থেকে বড়স্টেশন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ কিনতে এসেছেন জাহেদুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘রফতানির খবরে আগের তুলনায় প্রতি কেজির দাম চার থেকে ৫০০ টাকা বেশি চাচ্ছেন বিক্রেতারা। এজন্য ইলিশ কেনা যাচ্ছে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে ইলিশ।’

ইলিশ রফতানি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

প্রবাসী পলাশ আহমেদ বলেন, ‘ইলিশ রফতানি না করার সিদ্ধান্ত ভালো ছিল। তবে ভারত আমাদের প্রতিবেশী। ইলিশ পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করা ঠিক নয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের আমরা ছাড় দেবো, আবার কিছু ক্ষেত্রে তারাও আমাদের ছাড় দেবে। পূজা উপলক্ষে কিছু ইলিশ দেওয়া উচিত। তাই বলে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির আদেশ দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি সরকারের। এতে মাছের দাম বেড়ে গেছে।’
 
ঢাকা থেকে আসা রবিউল ইসলাম নামের এক ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছিলেন ইলিশ রফতানি হবে না। দেশের মানুষ খাবে। কিন্তু হঠাৎ কেন আবার ভারতকে ইলিশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো, আমরা উপদেষ্টার কাছে জানতে চাই। শুনেছি, গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রফতানি করেছে। অথচ বর্তমান সরকার এক বছরেই তিন হাজার মেট্রিক টন রফতানির ঘোষণা দিলো? তাহলে তারা এতদিন কেন ভারতবিরোধী কথা বলেছিল।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইলিশের এত কম আমদানির মধ্যে চাঁদপুর থেকে ভারতে এত টন ইলিশ রফতানি করা একেবারেই অসম্ভব

বড় ইলিশের দাম অনেক বেশি তাই দেশের মানুষ এখন খাচ্ছে জাটকা উল্লেখ করে রবিউল বলেন, ‘বড় বড় মাছ সব রফতানি করা হচ্ছে। এ বছর মৌসুমের শুরু থেকেই দাম বেশি ছিল। তাহলে কী তারা এতদিন মাছগুলো মজুত করে ভারতে পাঠানোর চিন্তা-ভাবনা করেছিল। আর আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিল।’

রফতানির ঘোষণায় কেজিতে বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা

চাঁদপুর বড়স্টেশনের মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলেন, এবার ইলিশের সরবরাহ কম। যতই দিন যাচ্ছে সরবরাহ ততই কমছে। এর মধ্যে ভারতে মাছ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার একদিন পরই কেজিতে ১৫০-২০০ টাকা বেড়ে গেছে। আগে এক কেজির ইলিশ বিক্রি করেছি এক হাজার ৬০০-৬৫০ টাকা। এখন এক হাজার ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রফতানির ঘোষণার পর থেকে এলসিতে মাছ নিচ্ছেন রফতানিকারকরা। এজন্য বাজারে দাম বেড়ে গেছে। আগে যে ইলিশের মণ কিনেছি ৬০ হাজারে, তা এখন ৭০ হাজার টাকায় কিনতে হয়।

তিন হাজার টন রফতানি অসম্ভব

চাঁদপুর বড়স্টেশনের মৎস্য ব্যবসায়ী নাছির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন আমাদের এখানে প্রায় ৫০০ মণ ইলিশ আসে। এর মধ্যে ৪০০ মণ সমুদ্রের। আর চাঁদপুরের লোকাল মাছ প্রতিনিয়ত কমছে। সরবরাহ কমার কারণে আমরাও হতাশ।

রফতানির ঘোষণার পরই কেজিতে দেড়শ-দুইশ টাকা করে বেড়ে গেছে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘মানুষ বাজারে এসে এক কেজি ইলিশের দাম এক হাজার ৯০০ টাকা দেখে আশাহত হচ্ছেন।’

বর্তমান সরকার ভারতে তিন হাজার টন ইলিশ পাঠানোর যে ঘোষণা দিয়েছে, তা পূরণ করা একেবারেই অসম্ভব উল্লেখ করে নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এত মাছ কীভাবে বাংলাদেশ থেকে পাঠাবে বুঝতে পারছি না। অর্থ উপদেষ্টা চাঁদপুর ঘাট সম্পর্কে যে কথাটি বলেছেন, সেটি অসম্ভব। আমার মনে হয়, তিনি চাঁদপুর ঘাটে কখনও আসেননি। এই ঘাট সম্পর্কে অবগত নন। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে এ কথা বলেননি। আমরা দীর্ঘদিন এখানে ব্যবসা করি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, তিন হাজার টন ইলিশ চাঁদপুর থেকে পাঠানো অসম্ভব।’

একই কথা বলেছেন চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সবে বরাত সরকার। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘সেপ্টেম্বর মাসে ইলিশে বাজার ভরপুর থাকার কথা। কিন্তু সে অনুপাতে মাছ নেই। তবে গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু মাছগুলোর বেশিরভাগই কোয়ালিটি সম্পন্ন না। আকারে ছোট। এগুলো রফতানি করার মতো মাছ নয়। ভারতে তিন হাজার টন মাছ রফতানি হবে কিনা তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে। সম্ভবনা খুবই কম। কারণ মাছের সরবরাহ একেবারেই কম। এ ছাড়া আর কয়েকদিন মাছ থাকবে। তারপর ১৩ অক্টোবর থেকে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।’

রফতানি করার ঘোষণার কারণে মাছের দাম বেড়েছে এটি বলবো না উল্লেখ করে সবে বরাত সরকার বলেন, ‘মাছের দাম কখনও ৫০ টাকা বাড়ে আবার কখনও কমে। তবে চাঁদপুরের ইলিশের আগের ঐতিহ্য এখন নেই। যে উপদেষ্টা বলেছেন চাঁদপুর থেকে একদিনে তিন হাজার টন রফতানি সম্ভব, তিনি হয়তো আগে যেভাবে দেখেছেন, তা থেকে বলেছেন। তবে আগের সেই পরিবেশ এখন নেই।’

ইতোমধ্যে ভারতে রফতানির খবরে ইলিশের দাম আরও বেড়ে গেছে

২০১৯ সাল থেকে ইলিশ রফতানি

২০১৯ সাল থেকে দুর্গাপূজার আগে ভারতে ইলিশ মাছ রফতানি করে আসছে বাংলাদেশ। এবারও এই রফতানি নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরে অনিশ্চয়তা ছিল। শুরুতে সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য রফতানি না করার সিদ্ধান্ত নিলেও গত শনিবার এ সিদ্ধান্ত বদলায়। ওই দিন ভারতে তিন হাজার টন রফতানির সিদ্ধান্তের কথা জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ৮ অক্টোবর শুরু হতে যাওয়া দুর্গাপূজার আগে বাংলাদেশের ইলিশ পাতে উঠবে ভারতীয়দের। 

আগে যে পরিমাণ রফতানি হয়েছিল

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার ৬৯৯ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ৩৯১ টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ রফতানি করা হয়েছে।

এবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তারের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে তিন হাজার টন ইলিশ রফতানির আদেশ দেওয়া হয়েছে। এজন্য আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ করার অনুরোধ করা হয়।

২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা

এদিকে প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে ১৩ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞার পরপরই শেষ হবে ইলিশের মৌসুম। তখন আবার জাটকা ধরার ওপর আট মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।

Source link

Related posts

টিআর-কাবিখার চাল ব্যবসায়ীদের গুদামে, পাচ্ছেন না শ্রমিকরা

News Desk

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের নতুন নিষেধাজ্ঞা

News Desk

মিছিল-স্লোগানে মুখরিত রংপুর নগরী

News Desk

Leave a Comment