ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে বেহাল সাফারি পার্ক
বাংলাদেশ

ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনিয়ম-দুর্নীতিতে বেহাল সাফারি পার্ক

গাজীপুর সাফারি পার্কে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা যেন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। এতে পার্কে বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পর্যটক, দর্শনার্থী ও স্থানীয় লোকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পার্কের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে পাচার, প্রাণী মৃত্যু ও রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ঘটছে নিত্যদিন। গত ১৬ জানুয়ারি পার্কের দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছে একটি নীলগাই। এখনও সেটি উদ্ধার করা যায়নি। এর আগে ২০২১ সালে একই পার্ক থেকে একটি নীলগাই পালিয়ে গিয়েছিল।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাতের আঁধারে পার্কের বনাঞ্চলের গাছ কাটা হয়। দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব গাছ পাচার হচ্ছে। ওই সময় কাটা গাছ পড়ে শব্দ হওয়ায় আতঙ্কে দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় নীলগাই। সেটি শ্রীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করলেও এখনও উদ্ধার করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি পার্কটির বিভিন্ন প্রকল্প ইজারা না দেওয়ায় রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

ভাওয়ালের শালবনের ৩ হাজার ৮১০ একর ভূমি পার্কের আওতায় ছিল। একসময় এখানে ঘন বৃক্ষরাজি থাকলেও কর্তৃপক্ষের গাছ পাচারের ফলে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। গাছ কাটার নিয়ম না থাকলেও কাটা হচ্ছে।

পার্কের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, কচ্ছপ বেষ্টনীর দক্ষিণ পাশে এবং ঝুলন্ত সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে একাধিক আকাশমণিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রাতের আঁধারে কেটে পাচার করা হয়েছে। কোর সাফারিতে প্রবেশের ডান পাশে নিয়মনীতি না মেনে একাধিক দোকান বসিয়েছেন পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। এতে করে পার্কের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রাণীদের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রাণীর মৃত্যু 

অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর পার্কে একটি সিংহ ও একটি ওয়াইল্ডবিস্ট মারা যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর মারা যায় একটি জিরাফ, যার ফলে পুরুষ জিরাফের অভাবে প্রজনন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ২০২১ সালে পার্কে তিনটি ক্যাঙারু মারা যাওয়ার পর থেকে ক্যাঙারুশূন্য হয়ে যায় কোর সাফারি। এ ছাড়া লেকগুলো একসময় ব্ল্যাক ও হোয়াইট সোয়ানে পরিপূর্ণ থাকলেও বর্তমানে একটিও নেই। প্রাণীর মৃত্যুর কারণ উদঘাটনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

যেভাবে দেওয়া হয় রাজস্ব ফাঁকি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের দুজন কর্মচারী জানিয়েছেন, মূলত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে পার্কে অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বেড়ে গেছে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার থাকাকালে দলীয় নেতাকর্মীদের পার্কটির বিভিন্ন প্রকল্প ইজারা দিয়েছিলেন। সরকার পতনের পর থেকে তারা পলাতক। এ সুযোগে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম অনিয়ম-দুর্নীতি করে সব কাজ একাই করছেন। প্রবেশগেটে দায়িত্ব পালন করছেন ধনারঞ্চজন ধনা। যারা দলবদ্ধভাবে পার্কে আসেন, বিশেষ করে স্কুল-কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১০০ লোক এলে ৩০-৪০ জনের টিকিট কেটে বাকি টিকিটের টাকা ভাগ করে নেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, ধনারঞ্চজন ধনা এবং তাদের সহযোগীরা। এটি নিত্যদিনের ঘটনা। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার যোগসাজশে এভাবে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। ইজারার মাধ্যমে পরিচালনার কথা থাকলেও বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে পার্কে কোটি কোটি টাকা ইজারার বকেয়া রয়ে গেছে। 

দীর্ঘদিন ধরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব গাছ পাচার হচ্ছে

অভিযোগ আছে, বন বিভাগের কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ইজারাদারদের সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রতি বছর পার্কের মূল গেট ও কোর সাফারি ইজারায় পাঁচ কোটি টাকা পাওয়ার সক্ষমতা থাকলেও বন বিভাগ ইজারা না দিয়ে নিজেরা পরিচালনার নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে। বর্তমানে পার্ক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন ইজারাদারের কাছে প্রায় আট কোটি টাকা বকেয়া পাওনা থাকলেও, তা আদায়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু জেলা প্রশাসকের রাজস্ব আদালতে মামলা করে দায় সেরেছে।

পাখির সঙ্গে সেলফি তোলার সুযোগ দিয়ে টাকা আদায় 

পার্কের সাফারি কিংডমের ভেতরে অবস্থিত ‘ম্যাকাও পাখিশালা’। সেখানে বিশাল জায়গাজুড়ে ছাউনির নিচে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যাকাও পাখির বাস। বিশেষভাবে তৈরি বেশ কিছু বড় বড় বাক্সের ভেতরে এসব পাখির বসবাস। পাখিশালার দায়িত্বে রয়েছেন রোকন উদ্দিন। দর্শনার্থীদের শরীরে, কাঁধে এবং হাতে ম্যাকাও পাখিকে বসিয়ে সেলফি তোলার পর জনপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত নেন তিনি। ওই টাকা পার্কের ফান্ডে না দিয়ে নিজেই নিয়ে যান। যদিও পাখি ও প্রাণী স্পর্শ করা দর্শনার্থীদের জন্য নিষিদ্ধ।

পার্কে প্রবেশেও অনিয়ম

বিকাল ৪টার পর কোর সাফারিতে প্রবেশের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করা হয়। বিকাল ৪টার পর ১৫০ টাকা করে নিয়ে টিকিট না দিয়ে দর্শনার্থীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। বিকাল ৫টার পর এখানে প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও যাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। ওই টাকা ভাগাভাগি করে নেন রোকন উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

পার্কের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের ভাগনি জামাই আলামিনকে চুক্তিভিত্তিক পার্কের গাড়িচালক পদে নিয়োগ দেন। গত ১৫ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় পার্কের ভেতর থেকে গাছ কেটে পিকআপে করে নিয়ে যান তিনি। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নতুন বাজার এলাকার একটি করাতকলে বিক্রি করার সময় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন। খবর পেয়ে রফিকুল ইসলাম তার লোকজন নিয়ে গিয়ে আলামিনকে ছাড়িয়ে আনেন। অথচ এ ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নতুন বাজার এলাকার একটি করাতকলে বিক্রি করার সময় স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন গাড়িচালক আলামিন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্কের বন বিভাগের এক কর্মচারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশে কচ্ছপ ও সাপ বেষ্টনীর দক্ষিণ পাশ থেকে ১৫টি আকাশমণি গাছ কেটে বিক্রি করা হয়। উটপাখি বেষ্টনীর পশ্চিম পাশে আগুন লাগিয়ে গজারি বন পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। পরে পোড়া গাছ বিক্রি করা হয়। অথচ এখানে কোনও গাছ কাটার নিয়ম নেই।’

সরেজমিনে যা দেখা গেলো

সরেজমিনে দেখা গেছে, পার্কের মূল গেটের বাইরে ইজারাবিহীন কয়েকটি দোকান বসানো হয়েছে। দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসব দোকান বসিয়ে তার নিজের লোক দিয়ে প্রতিদিন টাকা তুলছেন। 

বিকাল ৪টার দিকে দেখা গেছে, কোর সাফারি পার্কে দায়িত্বে থাকা বনকর্মী হারুন, আশরাফুল ইসলাম এবং সুমন বড়ুয়া দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা নিয়ে টিকিট না দিয়ে ভেতরে যেতে দিচ্ছেন। কোর সাফারির পূর্ব পাশেও ইজারাবিহীন দুটি দোকান বসানো হয়েছে। সেগুলো থেকেও টাকা তুলছেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লোকজন। 

ম্যাকাও পাখিশালাতে গিয়ে দেখা গেছে, দর্শনার্থীদের শরীরে, কাঁধে এবং হাতে ম্যাকাও পাখিকে বসিয়ে সেলফি তোলার পর টাকা নিচ্ছেন রোকন উদ্দিন।

স্থানীয় বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন ও দর্শনার্থী জাকির হোসেন জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে পার্কে বেহাল অবস্থা দেখা দিয়েছে। কোথাও কোনও ধরনের নিয়ম মানা হচ্ছে না।

পাখির সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ দিয়ে টাকা আদায়

যা বললেন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‌‘যখন ভিড় থাকে তখন টিকিট ছাড়া কিছু দর্শনার্থী ঢুকে যায়। টিকিট নিয়ে অনিয়ম তেমন একটা হয় না।’

গাছ পাচারের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‌‘পাচার নয়, গাছগুলো দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির পর সেগুলো কেটে নিয়ে যাওয়া হয়।’

গাছসহ ধরা পড়ার পর আলামিনকে ছাড়িয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পার্কে আমার কোনও আত্মীয়কে চাকরি দেওয়া হয়নি। এলাকার কিছু গরিব ছেলেকে কাজ দেওয়া হয়েছে। অন্য অভিযোগগুলো সঠিক নয়।’

তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন প্রধান বন সংরক্ষক

বন অধিদফতরের প্রধান বন সংরক্ষক (সিসিএফ) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গাজীপুর সাফারি পার্কের এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনও অভিযোগ আসেনি। তারপরও যেহেতু বিষয়গুলো জানতে পেরেছি, বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে এগুলো তদন্তের নির্দেশ দেবো। যাতে তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

Source link

Related posts

ইফতার ও সাহরিতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে : স্থানীয় সরকারমন্ত্রী

News Desk

দেশের ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত লবণেও প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা

News Desk

সংকটের মধ্যেই ৮ চিকিৎসককে বদলি

News Desk

Leave a Comment