পটুয়াখালীতে জোরপূর্বক ভিডিও ধারণ করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় রমেন ঘরামি নামে এক যুবকের আত্মহত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নিজাম খানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গ্রেফতার নিজাম ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত হলেও তার মূল পেশা ছিল প্রতারণা। সুপরিকল্পিতভাবে মেয়েদের সঙ্গে ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় ও বিয়ে করা ছিল তার নেশা।
বুধবার (৩০ জুন) গভীর রাতে পটুয়াখালী শহরের কাঠপট্টি এলাকা থেকে চার সহযোগীকেও গ্রেফতার করে দশমিনা থানা পুলিশ। এর আগে মূল পরিকল্পনাকারী এবং প্রধান অভিযুক্ত নিজাম খানকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-১১।
প্রধান আসামি নিজাম দশমিনা উপজেলার কাটাখালী গ্রামের নুর মোহাম্মদ খার ছেলে। গ্রেফতার সহযোগীরা হলেন- পটুয়াখালী পৌর শহরের কাঠপট্টি এলাকার খালেক হাওলাদারের ছেলে বেল্লাল হাওলাদার, কাদের সিকদারের ছেলে সাইদ সিকদার ওরফে আঁধার, শাহজাহান গাজীর ছেলে শাহেদ ওরফে মোডা শাহেদ ও আলতাফ মৃধার ছেলে শাহেদ ওরফে জোকার শাহেদ। তাদের সবার বয়স ২৭ থেকে ৩০ এর মধ্যে।
নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (আইন) মশিউর রহমান বলেন, ‘দশমিনা থানার আত্মহত্যার একটি মামলা আমাদের কাছে এলে ছায়া তদন্ত শুরু করি। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা নারায়ণগঞ্জের সিদ্বিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা অভিযান পরিচালনা করি। একপর্যায়ে ২৮ জুন (মঙ্গলবার) সকাল ১০টার দিকে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকা থেকে প্রধান নিজাম খানকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। এ সময় সে তার স্ত্রীর বাসায় অবস্থান করছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেফতারের পর নিজাম সবকিছু অকপটে স্বীকার করেছেন। এ কাজে আরও যারা জড়িত তাদের নামও বলে দিয়েছেন। পরে নিজামকে পটুয়াখালীর দশমিনা থানায় হস্তান্তর করি। নিজাম পেশাদার প্রতারক। প্রতারণার মাধ্যমেই সে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। ব্লাকমেইল করাই তার প্রধান পেশা। তার একাধিক বিয়ের খবরও শোনা গেছে। মূলত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই রমেনের সঙ্গে এক নারীর ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রথম দিকে রমেন লোকলজ্জার ভয়ে দুই লাখ টাকা দিলেও পরে গত ১৯ জুন আরও টাকার জন্য যখন চাপ দেয় তখনই রমেন ঘরামি গ্যাসের ট্যাবলেট খায়। এক পর্যায়ে কাটাখালি সড়কের ওপর লুটে পরলে স্থানীয় লোকজন তখন ভিডিও করে। এ সময় ছটফট করতে করতে প্রতারণার কথা বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তাকে প্রথমে দশমিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং পরে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।’
রমেনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সে দশমিনা উপজেলার কাটাখালী গ্রামের রনজিত ঘরামির বড় ছেলে। পেশায় প্রসাধনী পণ্য ব্যবসায়ী ছিলেন।
পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘দশমিনা থানায় মামলার পর প্রথমে জানতে পারি, প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছে। পরে র্যাব-১১ এর সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করলে স্বীকারোক্তি এবং তার দেখানো মতে বুধবার রাতে পটুয়াখালী শহরের কাঠপট্টি ও লোহালিয়া খেয়াঘাট এলাকা থেকে অপর আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।’
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছে কি-না সেটিও আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া যে নারীর সঙ্গে মৃত রমেনের ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল সেই নারীকেও খুঁজছি আমরা।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিজাম খান পটুয়াখালী পৌরসভার একটি প্রজেক্টে ‘কাজ আছে টাকা আছে, কাজ নাই টাকা নাই’ এই শর্তে ঝাড়ুদার হিসেবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। শহরের বনানী এলাকার দুটি সড়ক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের দায়িত্বে ছিল তার। কিন্তু গত ২১ জুনের পর সদর থানা পুলিশের তল্লাশির কারণে গা ঢাকা দেওয়ায় ওই প্রজেক্টের ইনচার্জ তার বেতন ও অস্থায়ী চাকরি থেকে তাকে বাদ দেন।
সূত্র জানায়, জলেরকল সড়ক এলাকার একটি কলোনিতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করলেও শহরে অন্য এলাকায় তার অপর স্ত্রী বসবাস করছেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জেও তার আরেক স্ত্রী রয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। ওই কলোনির মধ্যেই গ্রেফতারদের রমরমা আড্ডা চলতো দীর্ঘদিন ধরে-এমন তথ্য ওই এলাকার বাসিন্দারাই জানিয়েছেন।
নিহতর রমেনের মেজো ভাই সমেন ঘরামি বলেন, ‘সম্প্রতি পটুয়াখালী শহরের শেখ রাসেল শিশুপার্কের পাশে বাণিজ্য মেলা চলাকালে রমেনকে দশমিনা থেকে ডেকে নিয়ে আসে নিজাম। পাশাপাশি বাড়ি থাকায় ও পরিচিত হওয়ায় পটুয়াখালী মেলায় আসেন রমেন। এরপর কোনও এক মেয়ের সঙ্গে জোরপূর্বক তার অন্তরঙ্গ ভিডিও করে রাখে নিজাম। সেই ভিডিও ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পটুয়াখালী শহরের ঝাড়ু দেয় এবং একটি কলোনিতে থাকে এটুকুই জানতাম। কিন্তু ঝাড়ুদারের পেছনে সে যে এত নোংরামি করে তা জানা ছিল না।’
ভাইরাল ভিডিওতে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে রমেনকে বলতে শোনা গেছে, ‘একটা মাইয়ারে দিয়া আমার দুই লাখ টাকা নিছে। এহন খালি ফোন দেয় খালি টাহা দে টাহা দে। আমার কাছে দেওয়ার মতো টাকা নাই। আমারে মাইয়াডারে দিয়া জোর কইরা রাস্তায় বইয়া ভিডিও কইরা ছাইড়া দেছে। আমাদের বাড়ির দহিনদারে বাড়ি। সেই জন্য আমি বিষ খাইছি।’
দশমিনা থানার ওসি মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘আসামীদের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হলে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের পটুয়াখালী কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজন হলে তাদের রিমান্ড চাওয়া হবে।’