ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ী গ্রামে। সেই বাড়িটিকেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর জাদুঘর করেছে। নামকরণ করা হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তবাড়ি ও জাদুঘর।
যশোর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে কপোতাক্ষ নদের পূর্ব তীরে কবির এই বাড়ি। বছরের প্রায় সব সময়ই এখানে আসেন দর্শনার্থীরা। তারা ঘুরে ঘুরে দেখেন কবির জন্মস্থান, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র, হাতে লেখা চিঠি, শয়নের খাট, কাঠের সিন্দুক, লোহার সিন্দুক, কাঠের চেয়ার, মা- বাবা, স্ত্রী ও স্বজনদের ছবি, কলকাতা ও ফ্রান্সের তার আবাসস্থলের ছবি ইত্যাদি।
শুক্রবার (১৭ মে) সকালে কবির বাসভবন জাদুঘরে দেখা মেলে ঢাকার উত্তরা থেকে আসা ফারাহ তাবাসসুম নামে একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে। একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কনসালটেন্সি করতে তিনি কেশবপুরে এসেছেন। আর কেশবপুরে এসে তিনি সোজা চলে এসেছেন কবির স্মৃতিধন্য দত্ত বাড়িতে। ২০ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করেছেন। তার সঙ্গে কথা হয় কবির পিতা রাজনারায়ণ দত্তের কাছারিবাড়ির সামনে। যা এখন লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে মাইকেল মধুসূদন ছাড়াও অন্যান্য লেখকদের বই রয়েছে। বসে পড়ার জন্য রয়েছে দুটি টেবিল আর গোটা দশেক চেয়ার।
ফারাহ তাবাসসুম জানালেন, এই প্রথম তিনি কবির বাড়িতে এলেন। ঘুরেফিরে দেখছেন কবির স্মৃতিবিজড়িত নানা জিনিস।
সেখানেই কথা হয় সাগরদাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি ইনামুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন আর তেমন কেউ এই লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে না। বাইরে থেকে যারা আসেন, ছবি তোলেন; দাঁড়িয়ে একটু দেখেন তারপর চলে যান। লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ অনেক কমেছে।’
জাদুঘরে রক্ষিত কবির পারিবারিক ব্যবহৃত কাঠের বিশাল সিন্দুক দেখছিলেন বরিশাল থেকে আসা সেনাসদস্য ইলিয়াস কাঞ্চন ও তার কয়েকজন বন্ধু। যশোরে এই প্রথম তাদের আগমন। সাগরদাড়ীতে কবির স্মৃতিবিজড়িত নানা কাহিনি শুধু পড়েছেন বইয়ে। আজ তারা সরেজমিনে এলেন। গোটা ক্যাম্পাসের ছায়া সুনিবিড় পরিবেশ, গাছপালা, ফুলের বাগান, পরিপাটি গোছানো কবির বাসভবন দেখে সন্তুষ্ট তারা। পূজাঘর, জাদুঘর, পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন স্পটে বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন বলে জানান তারা।
সকাল থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শ খানেক দর্শনার্থী ভেতরে প্রবেশ করেন বলে জানান সেখানে দায়িত্বরতরা।
কবির জন্মস্থান বাড়িটি দোতলা। বাড়িটির ওপরতলা নিচতলাসহ মোট ৬টি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে কবির নানা আলোকচিত্র একটি ঘরে ঠাঁই পেয়েছে। বাড়ির সম্মুখভাগে রয়েছে একটি মন্দির যা কবির পরিবার পূজা অর্চনা করতো। একটি ঘরে (কাছারি ঘর) তৈরি করা হয়েছে পাঠাগার। বাড়ির প্রধান ফটকে রয়েছে কবি মধুসূদনের একটি ভাস্কর্য। সামনের দিকে একটি আম গাছের সঙ্গে আছে ফুলের বাগান।
জাদুঘরের ভেতরে কথা হয় মিউজিয়াম অ্যাটেনডেন্ট আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন এই গরমের সময় দর্শনার্থী একটু কম আসছে। রবিবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। প্রতিদিন এক থেকে দেড়শ দর্শনার্থী এখানে আসেন। শুক্র ও শনিবার সেই সংখ্যা আড়াই থেকে তিনশ পার হয়ে যায়।’ মূলত শীতের সময় বিশেষ করে জানুয়ারি মাসে এখানে দর্শনার্থীদের ঢল নামে বলে জানান তিনি।
জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারত থেকে বেশি দর্শনার্থী আসেন। এ ছাড়া আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের মানুষও আসেন।
নাজমা আক্তার নামে আরেক অ্যাটেনডেন্ট বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের চেয়ে সাধারণ দর্শনার্থীরা বেশি বেশি প্রশ্ন করেন। তারা জানতে চান কবির নানা গল্প। ছবি দেখিয়ে নানা বিষয়ে জানতে চান। আর শিক্ষার্থীরা এসে সেলফি তোলাতেই বেশি মগ্ন থাকে।’
পরিচারকেরা জানান, দর্শনার্থীরা জাদুঘর ঘুরে দেখার পাশাপাশি কবির দুই কাকার বাড়ি, তাদের পারিবারিক মন্দির, দুটি পুকুরপাড় এবং কবির ভূমিষ্ঠ হওয়ার স্থানে বেশি ঘোরাফেরা ও ছবি তোলেন।
জাদুঘরের লাইব্রেরি অ্যাটেনডেন্ট মিনতি চক্রবর্তী বলেন, ‘জাদুঘরটি ৪ দশমিক ৬১ একর জমিতে গড়ে উঠেছে। এখানে অফিসিয়াল ১৪ জন এবং আনসার সদস্য ৬ জন কর্মরত। এখন প্রতিদিন একশ থেকে দেড়শ দর্শনার্থী এলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে তা হাজার ছাড়ায়। এই বছরের জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছে। তা ছাড়া তখন স্কুলের বাচ্চাদের টিকিট নেওয়া হয়নি।’
তেমন কোনও অসুবিধা না থাকলেও তিনি জানান, জাদুঘরের এক্সটেনশনের জন্যে আবেদন করা হয়েছে। পাশের আরও ১২ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা গেলে সেখানে শিশুদের জন্য চিত্তাকর্ষক কিছু নির্মাণ ছাড়াও গাড়ি পার্কিং এবং পিকনিকের জায়গা করা যেতো। তাহলে এখানে আরও বেশিসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি থাকতো।
এসব বিষয়ে কথা হয় জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান হাসানুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মধুকবির স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানে মানুষ আসে; ভালোই আসে। আমরা নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্য মহোদয়ের সঙ্গে মিউজিয়ামের এক্সটেনশনের বিষয়ে আলাপ করবো।’
কবি, নাট্যকার, বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাড়ী গ্রামের এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল।
বাড়িটি নির্মাণে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত চুন-সুরকি ও ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে রয়েছে মধুসূদন দত্তের পৈত্রিক বাড়ি, তার কাকার বাড়ি, বাড়ি-সংলগ্ন পূজামণ্ডপ, দিঘিসহ উদ্যান।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক এখানে দুটো ভবন ও পূজামণ্ডপ সংস্কার সংরক্ষণপূর্বক একটি পাঠাগার ও একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে কবির আবক্ষ ভাস্কর্য। রয়েছে মধু উদ্যান। যাকে একসঙ্গে মধুপল্লি নামে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। পুরনো একটি একতলা ভবনে সংরক্ষণ করা হয়েছে মধুসূদন দত্তের বসতবাড়িতে ব্যবহৃত খাট, টেবিল, আলনা, কাঠের সিন্দুক, লোহার সিন্দুক প্রভৃতি। জাদুঘরের সামনে রয়েছে ১৯৮৪ সালে শিল্পী বিমানেশ চন্দ্রের তৈরি কবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। এ ছাড়াও মধুপল্লির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে নির্মাণ করা হয়েছে অপেক্ষাগার, প্রক্ষালন কক্ষ, প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবধারা বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয় ভাবনাগত যে আড়ষ্টতা ছিল মধুসূদন তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতা গুণে দূরীভূত করেন। ১৮৬০ সালে তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়ে রচনা করেন পদ্মাবতী নাটক। এ নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম এবং এর ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে এই সফলতা তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। পরের বছর ১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনি নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি মেঘনাদবধ কাব্য। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। এই কাব্যের মাধ্যমেই তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং তার নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার জেনারেল হাসপাতালে কবি মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি।