কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ভাঙনরোধে মাতামুহুরী নদীর ডান তীর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। দুই কিলোমিটারের বেশি এই প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে দুই ইউনিয়নের বাসিন্দারা বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনও ব্যবস্থা নেননি। কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমের নাম ভাঙিয়ে ঠিকাদার যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) অভিযোগ দিলেও কোনও কাজ হয়নি। অথচ প্রকল্পের কাজ তদারকি করছে পাউবো।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদী ভাঙনের কারণে চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নের দুই কিলোমিটার এলাকা প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ভেঙে যায়। এতে কয়েক বছর ধরে এখানকার ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, হাটবাজার ও ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দুই ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী কয়েকটি গ্রামের স্থানীয় লোকজন নদীর তীর সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এর ফলে ২০২২ সালের ২৩ জুন ২ দশমিক ২০ কিলোমিটার তীর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। চারটি প্যাকেজে প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে কৈয়ারবিল ইউনিয়নের ছোয়ালিয়া পাড়ার ৫০০ মিটার কাজের ঠিকাদার ফরিদুল আলমের চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি। পাশাপাশি আরও দুই ঠিকাদারের পাওয়া কাজ কিনে নিয়ে বাস্তবায়ন করছে এই প্রতিষ্ঠান।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ঠিকাদার ফরিদুল আলম প্রভাবশালী ব্যক্তি। সংসদ সদস্য জাফর আলমের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে কারও কথার গুরুত্ব দেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী অন্যত্র থেকে বালু এনে কাজ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ঠিকাদার নদীর তীরে শ্যালো মেশিন বসিয়ে বালু তুলে জিওব্যাগ ভর্তি করে বাঁধ তৈরি করছেন। এতে বর্ষায় জিওব্যাগের মাটি গলে ভেসে যাবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নকশা অনুযায়ী জিওব্যাগ বসানোর আগে নদীর তীরে স্ল্যাব করে চার ইঞ্চি বালু ফিলিংয়ের ওপর জিও টেক্সটাইল বিছিয়ে চার ইঞ্চি ইটের খোয়া ফেলে কাজ করার কথা। কিন্তু ঠিকাদার কোনও ধরনের বালু ফিলিং করেননি। জিও টেক্সটাইল ও ইটের খোয়া ফেললেও তা নিম্নমানের। তারপরও কোথাও চার ইঞ্চি খোয়া ফেলা হয়নি। কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছেন ঠিকাদার।
জিওব্যাগে এক বস্তা সিমেন্টের সঙ্গে ১০ টুকরি বালু দেওয়ার কথা থাকলেও ১৮-২০ টুকরি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমদ (৭০)। তিনি বলেন, ‘নদীভাঙনে ভিটে-জমি হারিয়ে এলাকার লোকজন সর্বস্বান্ত। আশা করেছিলাম, টেকসই বাঁধের কাজ হবে। কিন্তু ঠিকাদারের কাজ দেখে আমরা হতাশ। কোনো রকমে কাজ করছেন ঠিকাদার। বর্ষায় এসব ব্যাগ নদীতে ভেসে যাবে।’
এদিকে, প্রতিরক্ষা বাঁধের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ পেয়েছে।
কৈয়ারবিল ইউনিয়নের সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ফরিদুল আলম প্রভাবশালী এবং এমপির লোক। এ কারণে পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কাজে অনিয়ম করলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নদী থেকে বালু তুলে জিওব্যাগ ভর্তি করা হয়েছে। খুবই নিম্নমানের কংক্রিট ও সিমেন্ট কম দিয়ে জিওব্যাগ ভর্তি করে বাঁধের কাজ করেছেন ঠিকাদার।’
বাঁধের কাজের তদারকি না করা এবং অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিকু জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘নিম্নমানের কাজের অভিযোগ পেয়েছি। কাজের মান নিয়ে আমিও অসন্তুষ্ট। প্রকল্পের কাজে আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। দুই-তিনবার সেখানে গিয়েছি।’ প্রকল্পে ঠিকাদারের অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারবো না।’
বাঁধের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে চকরিয়া ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির স্বত্বাধিকারী ফরিদুল আলম বলেন, ‘মিলেমিশে খাওয়ার জন্যই প্রকল্পের কাজ করছি। এ নিয়ে লেখার কী আছে। লিখে কিছুই হবে না। প্রকল্পের কাজের সঙ্গে অনেকে জড়িত, আমি একা নই।’
প্রকল্পের কাজের দেখভালের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ‘কাজের মান ভালো আছে। তদারকি ঠিকমতো করা হচ্ছে।’ নকশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে কোনও সদুত্তর দেননি এই কর্মকর্তা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, ‘আমি এখন নির্বাচনি কাজে ব্যস্ত আছি, পরে এ বিষয়ে কথা বলবো।’