পিঠার নাম শুনলেই জিভে জল আসে না এমন মানুষ খুবই কম। বিশেষ করে শীতের পিঠা বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তো শীতের মধ্যেই বাঙালির ঘরে হাজির হয়েছে পিঠার আমোদ। গ্রামেগঞ্জে গৃহস্থবাড়িতে টাটকা চালে তৈরি হয় বাহারি পিঠা-পুলি। মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে মূলত ঋতুর প্রথমভাগ থেকেই।
বাঙালি ঐতিহ্য কী সুন্দর করেই না মা-বোনেরা তাদের কাছের মানুষগুলোকে পিঠা পরিবেশন করেন। এটাই যেন তাদের সৌন্দর্য। ঠিক তেমনি ঘরের আপ্যায়নের মতোই আপ্যায়ন মিলেছে এই পিঠা উৎসবে। মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) সকাল থেকে মোংলা উপজেলার বুড়িডাঙ্গা ইউনিয়নে পিঠা বানানো ও খাওয়ার ধুম চলে।
এদিন সকাল শুরু হয় মুখরোচক সব পিঠার ঘ্রাণে। বুড়িডাঙ্গা ইউনিয়নের কালীবাড়ী, বৈরাগখালী ও বাটারাবাদ গ্রামে প্রায় ১০ রকমের পিঠা নিয়ে হাজির হয়েছেন পিঠাশিল্পীরা। যার মধ্যে রয়েছে চিতই পিঠা, দুধচিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, তেলের পিঠা, তেজপাতা পিঠা, মুঠি পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, নকশি পিঠা ও সিঁয়াই পিঠা।
কনকনে শীত উপেক্ষা করে পিঠার স্বাদ নিতে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের নানান বয়সের হাজারো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয় এই উৎসব। এদিন সকালে সারিবদ্ধভাবে চুলা বসিয়ে বুড়িডাঙ্গা গ্রামের বিভিন্ন বয়সের নারীরা পিঠা তৈরি শুরু করেন। পরে সবাই একত্রিত হয়ে বসে পিঠা খাওয়া শুরু করেন। পিঠা খাওয়া শেষে কুইজের মাধ্যমে সেরা পিঠা তৈরি নারীদের দেওয়া হয় পুরস্কার। ভবিষ্যতে পিঠা উৎসবের এ আয়োজন পুরো জেলায় ছড়িয়ে দিতে চান আয়োজকরা।
পিঠা উৎসব আয়োজনের সহযোগী ও বুড়িরডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান উদয় শংকর বিশ্বাস বলেন, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে এখন আর গ্রামেগঞ্জে সেভাবে পিঠা উৎসব হয় না। সেই উৎসব এখন নানা আনুষ্ঠানিকতায় হচ্ছে। অন্তত এই উৎসবের কারণে আমরা আমাদের গ্রামের সেই পিঠাপুলির ঘ্রাণ নিতে পারছি, স্বাদ নিতে পারছি। গত সাত বছর ধরে আমার ইউনিয়নে এই পিঠা উৎসব হয়ে আসছে।’
পিঠাশিল্পী তৃষ্ণা বিশ্বাস, মিতা সর্দার, তনুশ্রী বিশ্বাস ও শিখা রায় ও প্রিয়া ঘোষাল বলেন, ‘শীতে জনপ্রিয় হচ্ছে পিঠা। কালের গভীরে কিছু হারিয়ে গেলেও পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলাই নয়, শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই পিঠা উৎসব পালন করা হয়। যতক্ষণ লোকজন এসেছে, ততক্ষণ পিঠা বানানো হয়েছে। সবাইকে নিমন্ত্রণ করে তৈরি করা এই পিঠা পরিবেশন করা হয়েছে।’
তারা আরও বলেন, ‘হিন্দু সমাজে পৌষপার্বণ, মুসলমান সমাজেও তেমনই ফুটে ওঠে পিঠা-পায়েসের আনন্দ এবং ঘরে ঘরে পিঠা উৎসব হয়। কিন্তু আমরা ঘরে ঘরে না করে সবাই একত্রিত হয়ে আন্তরিকভাবে নতুন উদ্যোগে একসঙ্গে পিঠা বানিয়ে উৎসব পালন করি। এতে সবাই আনন্দঘন পরিবেশ উপভোগ করেন।’
একসময় এ দেশে শত শত নামের ধান ছিল। তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা! পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার নারীদের ঐতিহ্য। পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনও অসংখ্য গান, কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লি মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষপার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’