যশোর কালেক্টরেট ভবনের জমি অধিগ্রহণ শাখার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন অভয়নগর উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলাম। যশোরের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ (ইপিজেড) প্রকল্প এলাকার ভেতরে তার ৩৮ শতক জমি রয়েছে। সিরিয়াল নম্বর ১৯৬। জমি অধিগ্রহণের চেক নিতে কালেক্টরেট অফিসের বারান্দায় ঘুরছেন বহুদিন ধরে। যখনই আসেন, কর্মকর্তারা বলেন পরের সপ্তাহে আসেন। এভাবে অন্তত ১০ বার এখানে এসেছেন। কিন্তু টাকা এখনও পাননি। এ নিয়ে হয়রানি ও ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন শহিদুল।
শুধু শহিদুল নন, এমন অনেকে এখনও জমি অধিগ্রহণের চেক পাননি। অথচ ইপিজেডের কাজ শুরু হয়ে গেছে। জমি অধিগ্রহণের টাকা না পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তারা।
যশোরে ইপিজেড
বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সূত্রে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইপিজেড স্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ আহরণ, রফতানি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আবদান রাখার জন্য যশোরে ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বেপজার বোর্ড অব গভর্নরের ৩৪তম সভায় এক হাজার ৬৭৮ দশমিক ২৯৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের চেঙ্গুটিয়া, মহাকাল, প্রেমবাগ, বালিয়াডাঙ্গা, আমডাঙ্গা, আরাজি বাহিরঘাট, মাগুরা এবং রাজাপুর মৌজায় ৫০২ দশমিক ৯০৬ একর জমিতে যশোর ইপিজেড প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এতে প্রত্যক্ষভাবে দেড় লাখ এবং পরোক্ষভাবে তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। দুই হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণ এবং বার্ষিক প্রায় দুই হাজার ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হবে বলে আশা করছেন প্রকল্ট সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পটি তিন বছরের। এটি ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা।
কাজ শুরু
যশোরের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাল খননের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পে থাকা অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গার ধলিয়ার বিল থেকে শুরু হয়ে মহাকালের আমডাঙ্গা খাল পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ ওই খালের প্রায় ৪০০ মিটার ইতোমধ্যে খনন সম্পন্ন হয়েছে। খালের মধ্যে পড়েছে দুটি পরিবারের ভিটামাটি ও বসতঘর। ওই দুটি পরিবার এখনও জমি, বাড়ি ও ফসলের ক্ষতিপূরণ পায়নি। শুধু ওই দুই পরিবার নয়, ইপিজেডের আওতায় পড়া বেশিরভাগ জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাননি। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
সরেজমিনে যা জানা গেলো
ইপিজেড অঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, ইপিজেডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। সীমানাঘেঁষে লাল রঙে ‘বেপজা’ লেখা কংক্রিটের সীমানা পিলার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাছের ঘের, ধানের জমি, বাড়ি এবং বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা রয়েছে। এক পাশে খাল খনন করা হচ্ছে। এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালের প্রশস্ত ছয় মিটার। খালের উৎসমুখে গভীরতা দুই মিটার এবং সংযোগস্থলে তিন মিটার। বালিয়াডাঙ্গার ধলিয়ার বিল থেকে শুরু হয়ে খালটি মহাকালের আমডাঙ্গা খালে পড়বে। সম্পূর্ণ খালটি আরসিসি ঢালাই হবে। ইতিমধ্যে কাজের প্রায় ৪০ শতাংশ খননের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
খালের মধ্যে পড়েছে দুটি পরিবারের বসতঘর। একটি বাড়ির মালিক উপজেলার আমডাঙ্গা গ্রামের বাবলু মোল্যা বলেন, ‘আমার দুই বিঘা ২১ শতক জমি এই প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। এর মধ্যে দুই বিঘা ধানি জমি এবং ২১ শতক ভিটেমাটি। সেখানে আমার বসতঘর। খাল কাটতে কাটতে ঘরের কাছে চলে এসেছে। আমার সিরিয়াল নম্বর ৯। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা পাইনি। টাকা না পেলে কোনও অবস্থায় বাড়িঘর ভাঙতে দেবো না।’
তারই প্রতিবেশী মুর্শিদা বেগমের ১৩ শতক জমিতে রয়েছে আধাপাকা ঘর। এই বাড়ির মধ্যে থাকা আটটি নারকেল গাছ, চারটি আম, চারটি সফেদা, একটি জাম আর ১২টি খেজুর গাছের মূল্য ধরা হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। জমি শতক প্রতি সাড়ে তিন লাখ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি কোনও টাকা পাননি। মুর্শিদা বলেন, ‘টাকা না পেলে ঘরবাড়ি ফেলে আমরা কোথায় যাবো? জমি কিনে বাড়িও বানাতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের একটি টাকাও দেয়নি সরকার। ক্ষতিপূরণের টাকা না পেলে কাজ বন্ধ করে দেবো।’
ইপিজেডের খালের মধ্যে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফারুক হোসেনের জমি পড়েছে ৫৮ শতক। খাল খনন চলছে অথচ তিনি কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি। ফারুক বলেন, ‘খালের মধ্যে জমি আছে ৪৩ জনের। টাকা পেয়েছেন মাত্র তিন জন। খাল খননের শুরুতে আমরা বাধা দিয়েছিলাম। এ সময় ১৫ দিনের মধ্যে সবার টাকা দেওয়া হবে এই শর্তে খাল কাটতে দিয়েছিলাম। কিন্তু এক মাস হয়ে গেলেও আমাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না।’
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ছাকিব হোসেনের পারিবারিক প্রায় ২৫ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি কোনও টাকা পাননি। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে কাগজপত্র জমা দিয়েছি। অথচ এখনও অধিগ্রহণের টাকা দেওয়া হয়নি। কয়েক দিন আগে এই এলাকায় জমির মালিকদের উদ্দেশে মাইকিং করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ওই জমিতে কেউ যেন নতুন করে চাষাবাদ না করে এবং যাদের ঘেরে মাছ রয়েছে, তারা সেগুলো ধরে ফেলে। ঘোষণার পর প্রায় ১০ বিঘাতে (৪২ শতক) এবার বোরো আবাদ করতে পারিনি। এতে কমপক্ষে এক হাজার মণ ধান হতো। একইসঙ্গে ১৫ বিঘার ঘেরে মাছও ছাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
মহাকাল গ্রামের দিলীপ ঘোষের জমি রয়েছে ১০ শতক। তার সিরিয়াল নম্বর ২১১। তিনিও ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি। দিলীপ বলেন, ‘একজনের সিরিয়াল ৫৫৫। তিনি টাকা পেয়েছেন। অথচ আমি টাকার জন্য ঘুরছি।’
বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের মাহবুব হোসেন পিন্টুর প্রায় ১০০ বিঘা জমি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে আবেদন করেছি। ক্ষতিপূরণ দিতে কালক্ষেপণ করার জন্য আবেদনের বিপরীতে মৌখিকভাবে অভিযোগ নেওয়া হচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঘের এবং জমির কোনও সংস্কার কাজ করতে পারছি না। ফলে ভবদহের জলাবদ্ধতার কারণে মাছের ঘের ভেসে মাছ বেরিয়ে গেছে। খেতের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।’
খাল খননের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান যা বলছে
খাল খননের কাজ করছে ঢাকার হোসেন কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামীম হোসেন বলেন, ‘প্রায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে খাল কাটা হচ্ছে। জানুয়ারির ১১ তারিখ থেকে খননকাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে এক কিলোমিটারের মধ্যে ৪০০ মিটার খননের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই খালের মধ্যে ৪৩ জনের জমি রয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। খাল কাটার শুরুতে জমির মালিকরা বাধা দিয়েছিলেন। তাদের বুঝিয়ে আমরা খাল খনন করছি।’
জমি হুকুমদখল আইন
স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ এর ১৩ ধারার উপধারা ১ ও ২ এ বলা হয়েছে, ধারা ১১ অনুসারে রোয়েদাদকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হলে বা প্রদান করা হয়েছে মর্মে বিবেচিত হলে অধিগ্রহণকৃত স্থাবর সম্পত্তি দায়মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিকট ন্যস্ত হবে এবং জেলা প্রশাসক ওই সম্পত্তির দখল গ্রহণ করবেন। কোনও স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণের পর জেলা প্রশাসক নির্ধারিত ফর্মে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবেন।
যা বললেন প্রকল্প পরিচালক
যশোর ইপিজেড স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইউসুফ পাশা বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর যশোরের জেলা প্রশাসককে ২৬৬ কোটি ৪৫ লাখ দেওয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন। ইপিজেডের কাজ চলমান। খাল খনন চলছে। বালু ভরাট ও রাস্তা নির্মাণকাজের দরপত্র ডাকা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বক্তব্য
জমি হুকুমদখল কর্তৃপক্ষ বলছে, জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত জমি, বাড়ি ও ফসলের মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছেন। এ পর্যন্ত এক হাজার ৬০০ জন জমির মালিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৪৬ জনের চেক হস্তান্তর, অ্যাকাউন্ট অফিসে ৪৪ জনের চেক প্রদান এবং প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে আরও নয় জন। অর্থাৎ, সবমিলিয়ে ১৯৯ জনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা তামান্না ফেরদৌসি বলেন, ‘প্রায় এক হাজার ৬০০ আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১৪৬ জনের ২০ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ৫১২ টাকা পরিশোধ হয়েছে। হিসাবরক্ষণ অফিসে ৪৪টি চেক পাঠানো হয়েছে এবং প্রক্রিয়ায় রয়েছে নয়টি। সবমিলিয়ে ১৯৯ জনের চেক বিতরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।’
যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৬০০ আবেদন পড়েছে। তার মধ্যে ৩৫০ জনের আবেদন যাচাই-বাছাই করে ১৯৯ জন যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪৬ জনের চেক দেওয়া হয়েছে। ১৫১ জন চেক পাওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন।’
টাকা দিয়ে দেরি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জমির মালিকানা নির্ধারণে সমস্যা রয়েছে। অনেকের জমি নিয়ে মামলা রয়েছে, অনেকের কাগজপত্রে সমস্যা আছে, কেউ কেউ জমির মালিকই নন, কেউ জমি কিনে বিদেশে গেছেন, তার পক্ষে স্বজনদের কেউ আবেদন করেছেন, আবার কেউ জমি বিক্রি করেও আবেদন করেছেন আবার যিনি কিনেছেন, তিনিও আবেদন করেছেন। এজন্য যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মালিককে চেক দিতে কিছুটা সময় লাগছে। আশা করছি, জুনের মধ্যে বেশিরভাগ যোগ্য মালিক টাকা পেয়ে যাবেন।’
যশোরের জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘ইপিজেডের জমি অধিগ্রহণ করে প্রত্যাশী সংস্থাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
অধিগ্রহণের পরও বেশিরভাগ মালিক কেন ক্ষতিপূরণ পাননি জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ এবং জমির ক্ষতিপূরণ দুটি আলাদা বিষয়। জমি অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। এখন সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে কাগজপত্র দেখা হচ্ছে। কাগজপত্র ঠিক থাকলে জমির মালিকরা অবশ্যই ক্ষতিপূরণের টাকা পাবেন। দ্রুততার সঙ্গে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হবে।’