সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে। এর মধ্যে যশোরে তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। প্রচণ্ড এই গরমে জেলার চাঁচড়া মৎস্যপল্লির ৩৬টি হ্যাচারিতে রেণুপোনা উৎপাদনে নেমেছে ধস। মরে যাচ্ছে পোনা। এতে ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে দাবি করেছেন হ্যাচারির মালিকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম বড় হ্যাচারিপল্লি যশোরের চাঁচড়ায়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশের সাদা মাছের রেণুর মোট চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করেন এখানকার হ্যাচারি মালিকরা। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে গত ১৫ দিনে রেণুপোনা উৎপাদন কমে ২৫ শতাংশে নেমেছে। ভূগর্ভের পানি উত্তোলন ব্যাহত হচ্ছে। পোনা মারা যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
মৎস্য চাষি ও হ্যাচারি মালিকরা জানিয়েছেন, তীব্র গরমে পানিতে মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পোনা বিক্রি কমে গেছে। কারণ অধিকাংশ স্থানে পুকুর ও জলাশয়ে পানি নেই। গরম পানিতে মাছও মারা যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। চলতি এপ্রিলের শুরু থেকে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। তার মধ্যে এই অবস্থা।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, যশোরে সমিতিভুক্ত রেণুপোনা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ৩৬টি। এর বাইরেও ১০-১৫টি আছে। এসব হ্যাচারিতে চলতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ কেজি রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু গরমের কারণে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশও পূরণ হয় কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এখানে প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোটি টাকার পোনা বিক্রি হতো। কিন্তু এপ্রিলের ১০ তারিখের পর থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকায় নেমেছে বিক্রি। যা ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
হ্যাচারি মালিকরা জানান, এপ্রিল মাসের শুরু থেকে যশোরে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়। একদিকে যেমন পানির সংকট অন্যদিকে পুকুরের পানি রোদে গরম হয়ে স্বাভাবিক তাপমাত্রা হারিয়েছে। এই পানিতে ডিম ছাড়লে তা থেকে পোনা উৎপাদন হচ্ছে না। সব ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে লোকসানে পড়েছেন তারা।
দুটি পুকুরে সাদা মাছের রেণু উৎপাদন করেন চাঁচড়ার চাষি মো. শাহজাহান। গত এক মাস ধরে পোনা উৎপাদন করতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রচণ্ড গরমে পানি উত্তপ্ত হয়ে মাছের ডিম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক জলাশয় শুকিয়ে গেছে। ফলে মাছ সংরক্ষণ কিংবা বিক্রি করার স্থান পাচ্ছি না।’
তাপপ্রবাহে পুকুরের তলদেশে গ্যাস জমে পানি গরম হয়ে যাচ্ছে জানিয়ে পোনা চাষি ও ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এই গরম পানিতে পোনা মারা যাচ্ছে। শনিবার দুই কেজির মতো মরা পোনা তুলেছি। চলতি মাসের শুরু থেকে ব্যবসায় ধস নেমেছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। হ্যাচারির কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে।’
কোনোভাবেই এখন রেণুপোনা উৎপাদন করা যাচ্ছে না জানিয়ে চাষি মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘হ্যাচারিতে যেগুলো আছে, গরমের কারণে সেগুলোও বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। রবিবার সাতক্ষীরার এক চাষি ২৩ হাজার পোনা নিয়েছেন। একটাও বাঁচেনি বলে দুপুরে জানিয়েছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার আমরা ৫০-৬০ লাখ টাকার ডিম বিক্রি করতাম। এখন ১০ লাখের বিক্রি করতে পারছি না। কিন্তু শ্রমিকের মজুরি, পানি উত্তোলনের জন্য বিদ্যুৎ ও ডিজেলের খরচ দিতে হচ্ছে। এসব কারণে লোকসান গুনতে হয়।’
মাছের ডিম, চারা, রেণুপোনা উৎপাদন ও বিপণন করেন চাঁচড়ার রবিউল ইসলাম রবি। বেচাকেনা মোটেও হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘খরচ কিন্তু প্রতিদিন ৮-১০ হাজার টাকা। এই গরমে তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। শুধু আমার না, এভাবে সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন।’
এমন পরিস্থিতিতে চাষিরা আগে কখনও পড়েননি বলে জানালেন চাঁচড়ার মাতৃফিস হ্যাচারির মালিক ও জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এমন পরিস্থিতিতে আমরা কখনও পড়িনি। হ্যাচারিতে রেণুপোনা উৎপাদন করা যাচ্ছে না। যেগুলো আছে সেগুলোও বিক্রি হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও কোনও ক্রেতা আসছেন না। কারণ পুকুর, খাল, ডোবা, নালায় পানি কমে গেছে। গরমে পানিতে থাকা মাছও মারা যাচ্ছে। মরে মরে ভেসে উঠছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আমাদের পথে বসতে হবে।’
গত ১০ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত হ্যাচারি মালিকদের ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান। তিনি বলেন, ‘এই ক্ষতি আগামী কয়েক মৌসুমেও উঠবে বলে মনে হয় না। শিগগির বৃষ্টি না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। তখন হয়তো ক্ষতির অঙ্ক শত কোটি ছাড়িয়ে যাবে।’
জেলা মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় মাছ স্বাভাবিক থাকে। ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস সইতে পারে মাছ। কিন্তু যশোরে তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেছে। এই তাপমাত্রায় মাছ রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না।
তীব্র তাপমাত্রার কারণে সরকারি মৎস্য খামারগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানালেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সরকার রফিকুল আলম। তিনি বলেন, ‘হ্যাচারি থেকে রেণু নিচ্ছেন না পোনা উৎপাদনকারীরা। কারণ রেণু নিয়ে পুকুরে ছাড়লেই গরমের কারণে মারা যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।’
যশোরে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে, এ অবস্থায় পোনা চাষিদের হ্যাচারি কিংবা ঘেরে প্রচুর পরিমাণ পানি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পানির স্বাভাবিক তাপমাত্রা যাতে ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, সেই চেষ্টা করতে হবে। তাহলে পোনা উৎপাদনে সমস্যা হবে না।’