ভেঙে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ট্রাফিক ব্যবস্থা। নিত্য যানজটে নাভিশ্বাস নগরবাসীর। যানজটের কারণে বিদেশগামী যাত্রী, অ্যাম্বুলেন্সের রোগী, শিক্ষার্থী, চাকরিজীবীসহ সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। অবৈধ ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন, সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং, উন্নয়ন কাজের জন্য যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, লক্ষাধিক অবৈধ রিকশার দাপট, ফুটপাত দখল করে হকার বাণিজ্য এবং সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যানবাহন চলাচল করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নগরীর যানবাহন নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ট্রাফিক পুলিশ আগের মতো কঠোর হচ্ছে না। এ সুযোগ নিচ্ছেন নগরীর অবৈধ চালক-মালিকরা। তার ওপর যানবাহন নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম নগরীতে একটি সিগন্যাল লাইটও সচল নেই। ট্রাফিক পুলিশ বাধ্য হয়ে হাতের ইশারায় লাঠি দিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে।
চট্টগ্রাম নগর ট্রাফিক পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, গত নভেম্বর মাসে ট্রাফিক আইন অমান্য করায় বিভিন্ন যানবাহনের বিরুদ্ধে ৫ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। একই সময়ে ৭ হাজার বিভিন্ন ধরনের গাড়ি জব্দ করা হয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, নগরীতে একসময় ৪০টি মোড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে সিগন্যাল লাইট ছিল। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে থাকা লাইটগুলোর একটিও বর্তমানে সচল নেই। সিগন্যাল লাইট সচলের জন্য ২০২২ সালে নতুন করে প্রকল্প নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। পরবর্তী সময়ে তা আলোর মুখ দেখেনি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিন ধরনের গণপরিবহনের জন্য ৪৬টি অনুমোদিত রুট আছে। সেগুলোর মধ্যে অটো টেম্পোর রুট ১৬টি, হিউম্যান হলারের রুট ১৬টি এবং বাস-মিনিবাসের রুট আছে ১৪টি। এসব অনুমোদিত রুটের বাইরে বিভিন্ন শ্রমিক-মালিক সংগঠন মর্জিমাফিক আরও কমপক্ষে ৪০টির বেশি অবৈধ রুট সৃষ্টি করেছে। এসব অনুমোদনহীন রুটে চলছে হাজার হাজার যানবাহন। যেগুলো অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ এবং বিআরটিএ’র নিবন্ধনহীন। ওইসব রুটে যাত্রী পরিবহন, যাত্রী ওঠানামায় নেই কোনও শৃঙ্খলা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ‘নগরীর মুরাদপুর, জিইসি মোড়, বহদ্দারহাট, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, ওয়াসা, টাইগারপাস, দেওয়ানহাট, চৌমুহনী, আগ্রাবাদ, বারেক বিল্ডিং মোড়, ফ্রি-পোর্ট, কাস্টমস মোড়, অক্সিজেন, অলংকার, একে খানসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই লেগে থাকে যানজট। এর মধ্যে নগরীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নির্মাণ এবং ওয়াসাসহ অন্যান্য সেবা সংস্থার চলছে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। নগরীর ওয়াসা মোড় সংলগ্ন বাউয়া স্কুলের সামনে নির্মাণ করা হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প। এ কারণে ওই সড়কে যানজট যেন লেগেই আছে। এ ছাড়াও সড়কে দেখা গেছে, যাত্রী নেওয়ার জন্য একই রুটের গাড়ির একটির সঙ্গে আরেকটির প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, সড়ক দখল করে গাড়ি পার্কিং, সড়কের পাশ ঘেঁষে স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন মার্কেট গড়ে উঠলেও রাখা হয়নি পর্যাপ্ত পার্কিং ব্যবস্থা। এসব কারণেও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে বলে দাবি স্থানীয়দের।
যানজট প্রসঙ্গে নগরীর মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা প্রকৌশলী আবদুল মুবিন চৌধুরী বলেন, ‘এক সময় নগরীর অলি-গলিতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলাচল করতো ব্যাটারিচালিত রিকশা। গত ৫ আগস্টের পর এসব রিকশা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশকেও এ বিষয়ে তেমন কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়াও অনুমোদনহীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ম্যাক্সিমা, ব্যাটারিচালিত টমটমসহ অন্যান্য যানবাহন নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তার ওপর সড়কে আছে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা ফিটনেসবিহীন একাধিক বাস, টেম্পুসহ বিভিন্ন গণপরিবহন। এসব গাড়ি সড়কে যানজট বাড়াচ্ছে।’
চট্টগ্রাম মহানগরী অটোরিকশা অটোটেম্পু মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে যানজটের মূল কারণ ছোট আকারের যানবাহন। নগরীর সড়কে ছোট আকারের যানবাহন কমার পরিবর্তে বেড়েছে। নগরীর সড়কে গত কয়েক বছরে হাজার হাজার অবৈধ যানবাহন ছিল। তার ওপর ৫ আগস্টের পর সড়কে অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা আরও বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীতে কমপক্ষে দশ হাজারের বেশি অবৈধভাবে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে। নগরীর অলি-গলিতে অবৈধ রুট সৃষ্টি করে এসব অটোরিকশা চলাচল করছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একাধিকবার প্রশাসনকে বলেছি। তারা বন্ধে কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। অবৈধ সিএনজি অটোরিকশার পাশাপাশি, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, টমটম, ব্যাটারিরিকশা, মাহিন্দ্র, ম্যাক্সিমাসহ বিভিন্ন ধরনের অবৈধ যানবাহন নগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের (ডিসি-উত্তর) জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য, চট্টগ্রাম শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা। একটি শহরকে শৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন। তবে চট্টগ্রামে সড়ক আছে মাত্র ১০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে পার্কিংয়ের সংকট। অতি দ্রুত চট্টগ্রাম শহরে পার্কিং প্লেস নির্ধারণ করা জরুরি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নগরীকে যানজটমুক্ত করতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবগুলো সেবা সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হলে যত্রতত্র বাসসহ যেকোনও যানবাহন দাঁড়াতে পারবে না। যাত্রী ছাউনি, বাসস্টপেজ যেখানে থাকবে সেখানেই দাঁড়াতে হবে। এ জায়গায় আমাদের কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। যত্রতত্র যানবাহন দাঁড়ানোর কারণে কেবল যে যানজট বাড়ছে তা নয়, বরং সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ এই অব্যবস্থাপনা।’