বিশাল ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং চীনের আধিপত্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারি থাকাটা যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের সঙ্গে লাগোয়া ভারতের সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটারের কম দূরে একটি উঁচু এলাকায় ১৮ থেকে ৩১ অক্টোবর ‘যুদ্ধ অভ্যাস’ শীর্ষক একটি যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ মহড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অংশীদারত্বের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত গুরুত্ব তুলে ধরে।
ভারত অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যূথবদ্ধ হয়ে বেশি বার্ষিক সামরিক অনুশীলন করে। কারণ, এ উভয় শক্তি তাদের বাহিনীর আন্তঃকার্যক্ষমতা উন্নত করতে চায়। মার্কিন নৌবাহিনীর নেভাল অপারেশনস প্রধান অ্যাডমিরাল মাইকেল এম গিলডে যেমন সম্প্রতি বলেছেন, চীনের উত্থান মোকাবিলায় ভারত একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার’।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তান-পালিত সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের কাছে দেশটিকে কার্যকরভাবে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত ছাড়াও রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উত্তেজনা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সর্বাধিক জনবহুল গণতন্ত্রের দুই দেশের সম্পর্ককে উত্তেজিত করেছে।
ইসরায়েল ও তুরস্কের মতো মার্কিন মিত্রসহ অন্যান্য অনেক দেশের মতো ভারতও ইউক্রেনের যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে বড় ধরনের ছাড়ে তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে এবং বাইডেন ভারতকে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনা বন্ধ করে তা আমেরিকার কাছ থেকে কেনার জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা ভারত প্রত্যাখ্যান করেছে। শুধু তা-ই নয়, ভারত উল্টো রাশিয়ান অপরিশোধিত তেলের আমদানি আগের চেয়ে অনেক বাড়িয়েছে।
ভারতের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীনের কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়। ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভারতকে সস্তা ইরানি তেল কেনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে আসছে। এ নিষেধাজ্ঞার প্রধান সুবিধাভোগী হলো চীন, যারা বিশেষ ছাড়ে ইরানের তেল কেনা বাড়িয়েছে।
তবু রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে বাইডেনের মাত্রাতিরিক্ত চেষ্টা ভারতের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে; বিশেষ করে যদি ভ্লাদিমির পুতিনকে চাপ দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা অসাবধানতাবশত সম্প্রসারণবাদী চীনকে ক্ষমতায়িত করে, তাহলে সেটি ভারতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার জ্বালানি থেকে ইউরোপের সরে যাওয়া কার্যকরভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদ-সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদ-ক্ষুধার্ত চীনের পকেটে ফেলেছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে পাকিস্তানকে সম্পূরক ঋণ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে ঋণখেলাপি হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। শুধু তাই নয়, এরপর পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান বহরের আধুনিকীকরণের জন্য আমেরিকা সম্প্রতি ইসলামাবাদের সঙ্গে ৪৫ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। এটি ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দেওয়ার তিক্ত স্মৃতি জাগিয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের দাবি, পাকিস্তানের মার্কিন সরবরাহকৃত এফ-১৬ বিমানবহরকে হালনাগাদ করা হলে তা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিষয়টি ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। ওয়াশিংটনে সাম্প্রতিক সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর প্রকাশ্যে এ চুক্তির নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন, আমেরিকান ব্যাখ্যা ‘কাউকে বোকা বানাতে পারছে না’ এবং পাকিস্তান নিঃসন্দেহে ভারতের বিরুদ্ধে এ উন্নত যুদ্ধবিমান মোতায়েন করবে।
এ পটভূমিতে কিছু পর্যবেক্ষক পুরোনো তত্ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক রিপাবলিকান প্রশাসনের অধীনেই ভালো যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় এ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নতি লাভ করেছিল। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বিকাশের জন্য ভারতের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করেছিল। ট্রাম্প চীন ও পাকিস্তানের ওপর নতুন মার্কিন নীতি চালু করেছিলেন। তিনি চীনের উত্থানে সহায়তা করার ৪৫ বছরের মার্কিন নীতির অবসান ঘটিয়েছেন। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করার জন্য তিনি পাকিস্তানের নিরাপত্তা সহায়তাও বন্ধ করেছিলেন।
অন্যদিকে, বাইডেন পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার আশকারা দেওয়া আবার শুরু করেছেন। তিনি বেইজিংয়ের কাছে পৌঁছানোকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং হিমালয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনের দখলের বিষয়ে কিছুই বলেননি। কিন্তু ৩০ মাস ধরে ষাঁড়ের মতো শিং বাগিয়ে সামরিক অবস্থান নিয়ে চীনের সঙ্গে ভারত এমনভাবে টক্কর দিয়ে যাচ্ছে, যা এ শতাব্দীতে অন্য কোনো বিশ্বশক্তি পারেনি।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের প্রতি বাইডেনের অবহেলাকে যে বিষয়টির চেয়ে ভালো করে আর কিছুই নির্দেশ করে না, সেটি হলো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নয়াদিল্লিতে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূত নেই। অন্যদিকে, পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডোনাল্ড ব্লোম পুরোদমে সক্রিয় রয়েছেন। কাশ্মীরের পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত অংশে সফরের সময় তিনি ‘পাকিস্তান–শাসিত’ কাশ্মীর না বলে তার বদলে এলাকাটির পাকিস্তানি নাম ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এ ছাড়া বাইডেন প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ইস্যুগুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এপ্রিল মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ভারতে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বেড়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁর এ অভিযোগ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে পাল্টা এমন মন্তব্য করতে প্ররোচিত করেছে যে ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয় দেশেই গণতন্ত্র কোণঠাসা অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থায় কর্মকর্তাদের এমন বক্তব্য এড়ানো উচিত, যা ঘরোয়া উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র যদি কৌশলগত ফোকাস ইন্দো-প্যাসিফিকের দিকে সরাতে চায়, তবে তাকে এশিয়ায় তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র যদি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে চায় এবং কৌশলগত ঝামেলা এড়াতে চায়, তবে তার ভারতকে আগের চেয়ে এখন আরও বেশি প্রয়োজন। কিন্তু তাকে মনে রাখতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা না থাকলে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারি ধ্বংস হয়ে যায়।