মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা। ২০-২৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ তাকিয়ে আছেন নদীর ওপারের দিকে। তাদের সঙ্গে আছে সাইকেল, মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক। সবাই অপেক্ষা করছেন কখন ঘাটে আসবে নৌকা। তাদের কেউ যাবেন কর্মস্থলে, কেউ বাজারে, কেউ শহরে আবার কেউ স্কুল-কলেজে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার পশ্চিম সাইতাড়া গ্রামের পাশেই আত্রাই নদীর ঘাটের এই দৃশ্য প্রতিদিনের। তাদের সঙ্গে অপেক্ষার প্রায় ৩০ মিনিট পর ওপার থেকে যাত্রী নিয়ে এপারে আসে নৌকাটি। ঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে নৌকায় ওঠেন অপেক্ষামান যাত্রীরা।
প্রতিদিন এভাবে নৌকার জন্য অপেক্ষা করে গন্তব্যে যেতে হয় পশ্চিম সাইতাড়া গ্রামের বাসিন্দাদের। ওপারে যেতে লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। নদী পার হতে অপেক্ষা করতে হয় আধা ঘণ্টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা। কারণ একটি মাত্র নৌকা চলাচল করে।
সাইতাড়া গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া থেকে এসেছে আত্রাই নদী। যেখানে দেড় মাস আগে নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছিল ৭১ জন। নৌকাডুবির পর থেকে ওই গ্রামের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আতঙ্ক ও দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে প্রতিদিন নৌকা পারাপার হতে হয়।
দিনাজপুর-২
সাইতাড়া গ্রামের পাশেই আত্রাই নদীর ঘাটের এই দৃশ্য প্রতিদিনের
পশ্চিম সাইতাড়া গ্রামের পূর্ব ও পশ্চিমে করতোয়ার দুটি শাখা নদী রয়েছে। একটি কাঁকড়া অপরটি আত্রাই। মাঝখানে প্রায় সাত হাজার পরিবারের ২০ হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামের মানুষকে প্রতিদিন হাটবাজার, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল কিংবা জরুরি প্রয়োজনে নৌকায় নদী পার হয়ে জেলা সদরে যেতে হয়। পাশাপাশি পূর্ব সাইতাড়া, বৈদেশিক পাড়া, ইন্দ্রপাড়া, রাবার ড্রাম ও ডাঙ্গারপাড়ার প্রায় ৩৫-৪০ হাজার মানুষকে জেলা সদরে একইভাবে যেতে হয়। ফলে বছরের পর বছর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
এসব গ্রামের ৫০টি ইজিবাইক ও ১৫০টি চার্জারভ্যানকে নৌকায় পার হয়ে জেলা সদরে যেতে হয়। এছাড়া প্রতিদিন ওসব গ্রামের শতাধিক শিক্ষার্থীকে নৌকাযোগে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করতে হয়।
স্থানীয়রা জানান, জেলা সদর থেকে গ্রামটিতে যাওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা। তবে সড়ক দিয়ে যেতে হলে ঘুরতে হয় ২৩ কিলোমিটার পথ। তাও আবার মাটির রাস্তা দিয়ে। তবে ওসব রাস্তা দিয়ে চার চাকার যান প্রবেশের সুযোগ নেই। চার চাকার যান তো দূরের কথা গ্রামের নাম শুনলে তিন চাকার ইজিবাইকও যেতে চায় না।
গ্রামবাসী জানিয়েছেন, পশ্চিম সাইতাড়া গ্রামে কোনোদিন অ্যাম্বুলেন্স কিংবা চার চাকার যান প্রবেশ করেনি। প্রবেশ করবেই বা কীভাবে, যাওয়ারই তো রাস্তা নেই। ফলে অসুস্থ রোগীদের নিতে হয় নৌকায় করে। অনেক সময় ঘাটে আবার নৌকায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় যাতায়াতের সুবিধার্থে ৪০ মিটারের একটি সেতুর দাবি জানিয়েছেন গ্রামবাসী।
দিনাজপুর-৩
প্রতিদিন এভাবে নৌকার জন্য অপেক্ষা করে গন্তব্যে যেতে হয় পশ্চিম সাইতাড়া গ্রামের বাসিন্দাদের
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গত জুলাই মাসের শুরুতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান গ্রাসের বাসিন্দা মোফাজ্জল হোসেন। তার ছয় মাস আগে মফিউদ্দিনের দেড় বছরের মেয়ে রাফিয়া জান্নাত অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তাকেও সময়মতো হাসপাতালে নেওয়া যায়নি। এক বছর আগে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কর্মচারী ওয়াহেদ আলী অসুস্থ হলে নৌকা ঘাটে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সময়মতো নৌকা ওপারে যেতে না পারায় ওয়াহেদ আলী মারা যান। দুই বছর আগে একইভাবে হাসপাতালে নিতে না পারায় মারা যান বিরেন দাস। তিন বছর আগে হাসপাতালে নেওয়ার সময় ঘাটে মারা যান জগদীশ রায়। সবার চোখের সামনে এসব ঘটনা ঘটলেও সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঘোষপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সফিকুল ইসলাম জানায়, ‘সকালে নৌকার জন্য ঘাটে বসে থাকতে হয়। কখনও কখনও ঠিকমতো ক্লাস করতে পারি না। দেরিতে যাওয়ায় আগে শিক্ষকরা বকাঝকা করতেন, এখন বাস্তবতা দেখে বকাঝকা করেন না। এখানের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ দেখার কেউ নেই।’
ওই গ্রামের শিক্ষার্থী পূরবী রানী জানায়, ‘আমি সাঁতার জানি না। নৌকায় উঠলে ভয় লাগে। স্কুলে যেতে সমস্যা হয়। সেতু হলে আমাদের উপকার হতো।’
একই গ্রামের বাসিন্দা রবিন চন্দ্র রায় বলেন, ‘এই ঘাট দিয়ে ছয়-সাত গ্রামের মানুষ নৌকা পারাপার হয়। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, সাইকেল, মোটরসাইকেল পারাপার হয়। আমাদের গ্রামে কখনও চার চাকার যান প্রবেশ করেনি।’
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সেতুর অভাবে উপজেলা শহরে ফসল নিতে পারি না। এজন্য ভালো দাম পাই না। ধান ও কৃষিপণ্য বিক্রি করতে যেতে হয় দুই দিন আগে। ভোগান্তির কারণে কেউ কৃষিপণ্য বাজারে নিতে চান না।’
খুরশিদা বেগম বলেন, ‘এই পথ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি যেতে হয়। কেনাকাটা কিংবা জরুরি প্রয়োজনেও যেতে হয়। নৌকার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। অন্তঃসত্ত্বা ও রোগীদের হাসপাতালে নিতে সমস্যায় পড়তে হয়।’
নৌকার মাঝি রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘাট দিয়ে হাজার হাজার মানুষজন চলাচল করেন। সকাল থেকে রাত ১টা পর্যন্ত নৌকা চালাই। একটা সেতু হলে হয়তো আমাদের উপার্জন কমবে তবে মানুষের দুর্ভোগ দূর হবে।’
দিনাজপুর-৪
আতঙ্ক ও দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে কয়েক হাজার মানুষকে প্রতিদিন নৌকা পারাপার হতে হয়
সাইতাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) রবিন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘প্রতিদিন এই ঘাট দিয়ে নৌকায় ৩৫-৪০ হাজার মানুষজন যাতায়াত করেন। এখানে সেতু না থাকায় কৃষকদের ধানসহ কৃষিপণ্য বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়। শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। মাঝেমধ্যে ঘটে দুর্ঘটনা। জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ, এখানে সেতু নির্মাণ করে মানুষকে ভোগান্তি থেকে মুক্তি দিন।’
সাইতাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তোষ কুমার রায় বলেন, ‘এলাকাবাসীর দাবির সঙ্গে আমি একমত। ওই স্থানে একটি সেতু জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। এ বছরের প্রথম দিকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলীরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু এরপর কি হয়েছে তা আমার জানা নেই।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের চিরিরবন্দর উপজেলা প্রকৌশলী ফারুক হাসান বলেন, ‘আত্রাই নদীর ওই অংশে সেতু করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন এলাকাবাসী। আমরাও তাদের দুর্ভোগের বিষয়টি দেখেছি। ওখানে যাতে সেতু নির্মাণ করা হয় সেজন্য সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদ সরকার বলেন, ‘আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। সুস্থ হওয়ার পর কথা বলবো।’