দেশে উৎপাদিত একমাত্র আঁশবিহীন সুস্বাদু রংপুরের হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা ক্রেতাদের কাছে শীর্ষে। গত ২০ জুন থেকে এ আম বাজারে আসার পর সারা দেশে এর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক বিষমুক্ত আম যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দামও।
ইতোমধ্যে জার্মানিতে রফতানি শুরু হয়েছে এ আম। এ ছাড়াও থাইল্যান্ডসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে রফতানি নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও আড়তদার ও রফতানিকারকেরা জানিয়েছেন।
হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানী বলে খ্যাত রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ ও আশপাশের ৫টি ইউনিয়নে লাল মাটি এলাকায় মূলত এই আমের চাষ হয়। এখন তা সম্প্রসারিত হয়ে দোঁয়াশ মাটিতে এ আমের বাগান গড়ে উঠেছে। এ বছর হাঁড়িভাঙা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় এটির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আঁশবিহীন, অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় প্রতিদিন বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস এবং ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক আম যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়। সকাল থেকে পদাগঞ্জ এলাকাসহ রংপুর নগরীর সিটি বাজার, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসংলগ্ন বিশাল বাজার বসে হাঁড়িভাঙা আমের। বিভিন্ন জেলা থেকে আড়তদাররা এসে আম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও স্বজনদের উপহার হিসেবে হাঁড়িভাঙা আম বিভিন্ন জেলায় পাঠাতে কুরিয়ার সার্ভিসে ভিড় করছেন মানুষ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আম সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
সরেজমিন হাঁড়িভাঙা আমের রাজধানী বলে খ্যাত পদাগঞ্জ হাট এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে দেড় কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিশাল বাজার বসে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকার ও সাধারণ মানুষ সেখানে ভিড় করেন। মূলত খিয়ার (লাল) মাটির আম অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতাদের মাঝে এই আমের চাহিদা বেশি। পদাগঞ্জ থেকে সরাসরি আম কিনে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের যেকোনও জেলায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস সেখানে তাদের অস্থায়ী বুকিং অফিস খুলেছে। সওদাগর, ইউএস বাংলা, জননী , সুন্দরবন, এস এ পরিবহনসহ বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিস তাদের গাড়িতে ২০ কেজির খাঁচাতে করে আম বুকিং করে কেজিপ্রতি ১০ টাকা করে নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে সওদাগর কুরিয়ার সার্ভিসের ম্যানেজার আফতাব হোসেন জানালেন, তাদের ৩-৪টা কাভার্ডভ্যানে শত শত খাঁচা হাঁড়িভাঙা আম ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছেন গ্রাহকেরা। একই কথা জানালেন জননী কুরিয়ার সার্ভিসের সহকারী ম্যানেজার লিটন পারভেজ।
এদিকে ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে কয়েকটি ব্যাংকের অস্থায়ী শাখা অফিস খোলা হয়েছে সেখানে। এ ছাড়াও বড় বড় আড়তদাররা সরাসরি ট্রাকে করে আম কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জেলায়।
রাজশাহী থেকে হাঁড়িভাঙা আম কিনতে এসেছেন আড়তদার মকবুল হোসেন। তিনি জানান, রাজশাহীর মিশ্রিভোগ, ল্যাংড়াসহ বিভিন্ন জাতের আমের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এবার তাদের জেলায় হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদাও বেড়েছে। আর তাই এবারই প্রথম হাঁড়িভাঙা আম কিনতে সরাসরি পদাগঞ্জ এসেছেন।
পদাগঞ্জ ছাড়াও দেশের অন্যতম বৃহৎ মার্কেট সিটি বাজার ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসংলগ্ন এলাকায় হাঁড়িভাঙা আমের আড়তে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশাল বাজার বসছে। সিটি বাজারের আড়তদার সাজু আহাম্মেদ জানালেন, গত ২০ জুন এক টন হাঁড়িভাঙা আম জার্মানিতে রফতানি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শুরু হলো বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে আম রফতানি। ঢাকার গ্রিন গ্লোবাল অ্যাগ্রো লিমিটেডের মাধ্যমে গিয়েছে এই আম।
ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক কাওছার আহম্মেদ এসেছিলেন রংপুরে। এ ব্যাপারে তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, গত বছর মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে হাঁড়িভাঙা আম রফতানি করা হয়েছিল। এবার জার্মানি থেকে অর্ডার পাওয়া গেছে। আমরা ১ টন দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম।’ সেখানে এ আমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
অন্যদিকে সিটি বাজারের আড়তদার মোস্তাফিজার রহমান ও আনিসুল হক জানান, তারা আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই এসব দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছেন। আশা করা হচ্ছে, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই একশ কোটি টাকার আম রফতানি করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে এবার হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদা আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক রিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন, রংপুরের ঐতিহ্যবাহী হাঁড়িভাঙা আম রংপুরের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। এবার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা।