রংপুরে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। ঘন কুয়াশায় গত সাত দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ফলে দিন ও রাতে একই রকম শীত অনুভূত হচ্ছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিক চেয়ে দুই-তিনগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ শিশু। গত ছয় দিনে এই হাসপাতালে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে মারা গেছেন বয়স্ক ছয় জন।
তবে হাসপাতালের শিশু বিভাগের রেজিস্টার খাতায় ঠান্ডাজনিত রোগে মৃত্যুর কোনও তথ্য নেই। এমনকি শিশু বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে রাজি হননি। হাসপাতালের পরিচালক বলেছেন, এটি হাসপাতালে স্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা।
শিশু বিভাগের দুটি ওয়ার্ডের সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের তিনতলার ৯ ও ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ৮০ শয্যার বিপরীতে শনিবার (১৩ জানুয়ারি) বিকাল পর্যন্ত ভর্তি আছে তিন শতাধিক শিশু। কোনও কোনও বেডে তিন-চার জন শিশু রোগীকে রাখা হয়েছে। শয্যা সংকটের কারণে অনেক শিশুকে হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডায়রিয়া রোগীদের আলাদা রাখার জন্য ১০টি শয্যা বরাদ্দ আছে। এর বিপরীতে রোগী ভর্তি আছে ৪০ জনের বেশি। দুটি ওয়ার্ডের বেশিরভাগ শিশু জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এসব ওয়ার্ডে গত ছয় দিনে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের অধিকাংশই মারা গেছে ঠান্ডাজনিত রোগে। পাশাপাশি মেডিসিন ওয়ার্ডে ছয় বয়স্ক ব্যক্তি শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মারা গেছেন।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, মেডিসিন, শিশু ওয়ার্ডসহ সব কটি ওয়ার্ড রোগীতে পরিপূর্ণ। এর মধ্যে শিশু ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে অধিকাংশ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একইভাবে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড় দেখা গেছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, আন্তবিভাগ ছাড়াও বহির্বিভাগে প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছে গড়ে তিন শতাধিক শিশু। শিশু ওয়ার্ডে জায়গা না থাকায় মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শত শত শিশুকে নিয়ে তাদের অভিভাবকরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষা করছেন।
বহির্বিভাগের কর্তব্যরত দুজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শয্যা সংকট থাকায় গুরুতর অসুস্থ ছাড়া অন্যদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
এক বছরের কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে বহির্বিভাগের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মিঠাপুকুর উপজেলা থেকে আসা আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয় মেয়েটি। এর মধ্যে ডায়রিয়া শুরু হয়ে যায়। এ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে এসে দেখি দীর্ঘ লাইন। এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। রোগীদের দীর্ঘ লাইনের কারণে এখনও চিকিৎসক দেখাতে পারিনি।’
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই জ্বর-সর্দি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছে। গত কয়েকদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন স্বজনরা।
শিশু বিভাগে দিনে কত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে জানতে চাইলে ৯ এবং ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের কর্তব্যরত দুই চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালের পরিচালকের অনুমতি ছাড়া কোনও তথ্য সাংবাদিকদের দিতে পারবেন না তারা। এ নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ জানিয়েছেন এই দুই চিকিৎসক।
শীতজনিত রোগে গত ছয় দিনে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন হাসপাতালে বিভিন্ন রোগে ২০-২৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু। মেডিসিন ওয়ার্ডের মৃত্যুগুলোও স্বাভাবিক। শীতজনিত রোগে ছয় দিনে ১৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে, এটি নির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। এসব মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না, এজন্য আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই।’
ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দিনে শত শত শিশু রোগী হাসপাতালে আসছে জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বলেন, ‘এর মধ্যে বেশিরভাগ রোগীকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাদের অবস্থা গুরুতর তাদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডগুলোতে শয্যার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় এখন ভর্তি নেওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে।’
শীতের তীব্রতা বাড়ায় শিশু ও বয়স্কদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়ে ডা. ইউনুস আলী আরও বলেন, ‘এই সময়ে যে কেউ ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এসব রোগ থেকে রেহাই পেতে গরম কাপড় ব্যবহার, যতটা সম্ভব ঠান্ডা পরিবেশ এড়িয়ে চলা জরুরি। শিশুদের ঠান্ডা বাতাস থেকে দূরে রাখা, সেইসঙ্গে ধুলাবালু থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে হবে। শৈত্যপ্রবাহ চলাকালে শিশুদের ঘর থেকে কম বের করতে হবে। ঘরের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস যেন না ঢোকে, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।’
নগরীর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছে রংপুর অঞ্চল। সাত দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। তীব্র শীতে নগরীতে মানুষের চলাচল কমে গেছে। শপিংমল ও দোকানপাটে ক্রেতা নেই বললেই চলে। শীতের কারণে মানুষ ঘর থেকে কম বের হচ্ছেন। ফলে শ্রমজীবী মানুষের আয় কমে গেছে।
নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ের মেগামল শপিং সেন্টারের ম্যানেজার সাফায়েত হোসেন জানিয়েছেন, শীতের সঙ্গে হিমেল বাতাস মানুষের জীবনযাত্রাকে অচল করে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এজন্য বেচাকেনা কমে গেছে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, তীব্র শীত আরও দুই-তিন দিন থাকতে পারে। এরপর ১৭ থেকে ১৯ জানুয়ারি আকাশ মেঘলা থাকবে। বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টির পর আবার তীব্র শীত নামবে। মাসের বাকি সময় থাকতে পারে তীব্র শীত। এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, সিলেট, যশোর ও চুয়াডাঙ্গাজুড়ে বয়ে যেতে পারে শৈত্যপ্রবাহ।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার রংপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ছিল ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার বিকালে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে এসেছে। তীব্র শীতের প্রধান কারণ শৈত্যপ্রবাহ নয়, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়া। আগামী দুই-তিন দিন শীত বেশি থাকতে পারে। এরপর কিছুটা স্বাভাবিক হবে।’
এদিকে, শীতে কষ্ট পাচ্ছেন নিম্নআয়ের মানুষজন। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় অনেকে খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ স্বল্পমূল্যে শীতবস্ত্র কিনতে পুরোনো পোশাকের দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন। সরকারিভাবে জেলায় এখন পর্যন্ত শীতার্ত মানুষের মাঝে তেমন শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মোস্তফা সাইফুল বলেন, ‘প্রয়োজনের তুলনায় শীতবস্ত্র বিশেষ করে কম্বল কম বরাদ্দ পাওয়ায় সবার মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা যায়নি। আমরা চাহিদাপত্র দিয়ে ত্রাণ অধিদফতরে চিঠি দিয়েছি। বরাদ্দ পাওয়ার পর নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।’