মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি অধিকৃত রাখাইন রাজ্যে হানাহানি বন্ধ হলে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে রাখাইনেই ফেরতে চান কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা। তবে আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইনে কীভাবে তাদের ফেরাবে জান্তা সরকার, সে প্রশ্নও আছে রোহিঙ্গাদের। এক্ষেত্রে আগে জান্তা সরকারকে আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। সমঝোতা হলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজেদের ভিটায় ফেরাতে হবে। না হয় আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে। সোমবার (০৭ এপ্রিল) উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নাগরিক ও তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি আরাকান আর্মির দখলে
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, ১১ মাসের বেশি সময় ধরে লড়াই-সংঘাতের পর গত বছরের ৮ ডিসেম্বর রাখাইন রাজ্যের ৮০-৯০ শতাংশ এলাকা (২৭০ কিলোমিটার) নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। এরপর রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে আরকান আর্মি। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দুই মাস রাখাইনে শান্ত অবস্থা বিরাজ করলেও মার্চের শুরু থেকে আবার সংঘাতে জড়ায় দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
২০২৪ সালে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের মাংগালা গ্রাম থেকে পালিয়ে টেকনাফের দমদমিয়া ক্যাম্পে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেন মোহাম্মদ আমির হোসেন (৫০)। মিয়ানমারে ফেরার বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভিটেমাটি অর্থাৎ রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির দখলে। সেখানে আমাদের নিয়ে কোথায় রাখবে, এটি কিন্তু এখনও স্পষ্ট করেনি জান্তা সরকার। তারা কোথায় নিতে চায়, আমরা যদি ভিটেমাটি ফিরে না পাই তাহলে কোথায় যাবো। কীভাবে যাবো। সেজন্য আগে জান্তা সরকারকে আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করতে হবে। সমঝোতা হলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আরাকানেই ফিরতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জান্তা সরকারের নতুন কোনও কৌশল কিনা সেটি চিন্তা করে দেখা দরকার। কারণ সেখান থেকে আমাদের বিতাড়িত করেছিল। এখন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে জান্তা সরকারের যুদ্ধ চলছে। এমন পরিস্থিতির মধ্য কীভাবে তারা আমাদের সেখানে নেবে। সেখানেও যদি আশ্রয়শিবিরে থাকতে হয়, তাহলে আবার অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে আমাদের।’
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা তরুণ আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে চাই। সেজন্য নিশ্চয়তা চাই, যাতে আবার আমাদের বিতাড়িত না করে। তবে শঙ্কা হলো রাখাইনে এখনও যুদ্ধ চলছে। সেখানে কীভাবে যাবো? আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, সেটি আগে পরিষ্কার করে জানাতে হবে জান্তা সরকারকে। এ ছাড়া আমাদের কিছু শর্ত আছে। এর মধ্যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, নাগরিকত্ব দিতে হবে, ভিটেমাটি ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দিতে হবে।’
দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের নিতে ৫২ বছরের বেশি সময় লাগবে?
আশ্রয়শিবিরে বাসিন্দা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এতো বছরের মধ্যে জান্তা সরকার শুধু এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার তথ্য বাছাই শেষ করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে, এটি চিন্তার বিষয়। এতোদিন পর কেন মাত্র এক লাখ ৮০ হাজার নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে, এটি আমাদের কাছে পরিষ্কার না। এখানে সংশয় আছে। বর্তমানে নতুন-পুরোনো মিলে ১৪ লাখের মতো রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে বাংলাদেশে। তবে কমবেশি হতে পারে। বাকিদের কী হবে? আর যদি দফায় দফায় নিয়ে যাওয়ার কথা তারা ভাবে তাহলে তো ৫২ বছরের বেশি সময় লাগবে সব রোহিঙ্গাকে নিতে। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের কোথায় নিয়ে রাখবে, সেটি কিন্তু জানায়নি তারা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি এখন আরাকান আর্মির দখলে। সেখানে আসলে কীভাবে যাওয়া সম্ভব আমার বুঝে আসছে না। তবে আমরা ফিরতে চাই সেখানে। বিতাড়িত হতে চাই না। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের এটাই অনুরোধ, রোহিঙ্গাদের বিপদের দিকে ঠেলে দেবেন না।’
রাখাইন রাজ্যে এখনও সংঘাত
সর্বশেষ ৬ এপ্রিল মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির অধিকৃত রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপসহ আশপাশের এলাকায় নতুন করে গোলাগুলি ও সংঘাতের খবর পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিন বন্ধ থাকার পর আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। সংঘাতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহতের খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, আরাকানে এখনও চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসতি আছে। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যে দুই লাখের বেশি বসতি আছে। সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন এবং হুমকি অব্যাহত রেখেছে আরাকান আর্মি। এতে বোঝা যাচ্ছে, সেখানের পরিস্থিতি এখনও অস্বাভাবিক।
উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১) বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ‘রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। সেখানে আমার দুজন স্বজন আছেন। তারা মংডু টাউনশিপে আছেন। রবিবার সবশেষ তাদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, আরাকান আর্মি তাদের ঠিকমতো চলাফেরা করতে দিচ্ছে না। তারা মাইকিং করে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে নির্দেশ দেয়। তারপর ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালায়। মংডু টাউনশিপে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের আরসার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখার ব্যাপারে সতর্ক করছে। পাশাপাশি মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত সাতটি গ্রাম ঘিরে রেখেছে। এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে ঠেকাতে সীমান্ত পথসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। কোনও অভিযোগ ছাড়াই যে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’
রবিবার ফোনে মংডু উত্তরের নরবনিয়া গ্রামে থাকা বোনের সঙ্গে কথা বলেছেন টেকনাফের দমদমিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা আমির হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার বোন বলেছেন, নরবনিয়া গ্রামে আরাকান আর্মি মাইকিং করে সবাইকে ঘর থেকে বের হতে নির্দেশ দেয়। এরপর ঘরে তল্লাশি চালায়। সবাইকে রোদে বসিয়ে রাখে চার-পাঁচ ঘণ্টা। প্রতিদিন এভাবে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি।’
সীমান্তে আগুন
এদিকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের আলোচনা সামনে আসার পর সোমবার সকালে রাখাইনের অভ্যন্তরে আগুনের কুণ্ডলী ও ধোঁয়া দেখা গেছে আকাশে। মূলত সেদেশে রোহিঙ্গাদের থাকা ঘরবাড়ি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলে কক্সবাজারের ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন।
উখিয়া ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আলোচনা সামনে আসার পর সেদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। এ ছাড়া পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। মূলত রোহিঙ্গারা ফিরে গিয়ে তাদের রেখে আসা ঘরবাড়িতে যাতে আশ্রয় নিতে না পারেন, সেজন্য আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে তারা।’
থামছে না অনুপ্রবেশ
রাখাইনে এমন যুদ্ধের মধ্যে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ থামছে না। সম্প্রতি নতুন করে কক্সবাজারে আরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে ক্যাম্প সূত্রে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক সংখ্যা কম বলে দাবি করে আসছে। সর্বশেষ গত ২২ মার্চ রাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম উপকূলে রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকাডুবির ঘটনায় চার রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নৌকা ডুবে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ সময় ২৫ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়।
রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা হয় আমাদের। সেখানকার পরিস্থিতি এখনও অশান্ত। ফলে রোহিঙ্গারা এখনও বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। গত রবিবার আমার ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন আশ্রয় নিতে আসেন। কিছুদিন আগে পালিয়ে আসার সময় সমুদ্রে রোহিঙ্গাদের বহনকারী নৌকা ডুবিতে কয়েকজন মারা যান। পালিয়ে বেড়ানো এই জীবন কবে শেষ হবে, তা আমাদের জানা নেই।’
নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ১৩ লাখের বেশি
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। দীর্ঘ ৮ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। উল্টো গত কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয়শিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন ৬০-৭০ হাজার রোহিঙ্গা।
তবে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভাসানচরে ৩৬ হাজার ৩৭৬ জনসহ কক্সবাজারের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ১০ লাখ ছয় হাজার ৫৭৪ জন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। দফায় দফায় আলোচনা এবং প্রতিশ্রুতির পরও গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। এরই মধ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।