সারা দেশের মতো রাজশাহীতেও চলতি মাসের শুরু থেকে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এই অসহনীয় গরমে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষ। রেহাই পাচ্ছে না পরিবেশে টিকে থাকা জীব-জন্তুও। হিটস্ট্রোকের কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় প্রতিদিন পোলট্রি খামারের মুরগি মারা যাচ্ছে। এতে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন প্রান্তিক খামারিরা।
এমন পরিস্থিতিতে ডিম ও মুরগি উৎপাদন ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে মুরগি ও ডিম সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খামারিরা।
রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবমতে, জেলায় প্রায় তিন হাজার খামার আছে। আর সরকারি হিসাবে আছে আট হাজার খামার। ক্ষতির কারণে মুরগির খামারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই ব্যবসা মুখ থুবড়ে পরবে বলে আশঙ্কা করছে অ্যাসোসিয়েশন।
গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী এলাকার খামারি রোকনুজ্জামানের খামারে মুরগি আছে প্রায় এক হাজারের মতো। শখের বসে তিনি তার ছাদে ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করেন। হিটস্ট্রোকে প্রতিদিন তার চার থেকে পাঁচটি করে মুরগি মারা যাচ্ছে। আর এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ চলে গেলেও তার দু-একটি করে মুরগি মারা যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে জেনারেটর ভাড়া করে এখন মুরগিকে বাতাস দেওয়া লাগছে।
তিনি জানান, মুরগিদের জন্য আলাদাভাবে বাতাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এই গরমের কারণে মুরগির ওজন কমে যাচ্ছে। মুরগির বেড়ে ওঠা ও শারীরিক ওজন অনেক ধীরগতিতে হচ্ছে।
পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের আশরাফের মোড়ের খামারি নজরুল ইসলামের পাঁচটি খামার রয়েছে। পাঁচটি খামারে প্রায় ২০ হাজার সাদা লেয়ার মুরগি আছে। প্রতিটি খামার আছে চার হাজার করে মুরগি। একটি খামারে গত এক মাসে ১২টি মুরগি মারা গেছে। এযাবৎ তার পাঁচটি খামারে প্রায় ৫০টি মুরগি মারা গেছে।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে মুরগিগুলো মারা যাচ্ছে। তীব্র দাবদাহ কমে গেলে মুরগি মারা যাওয়াও কমে যাবে। তবে এখনও আশঙ্কাজনক হারে মুরগি মারা যাচ্ছে না। বেশি মুরগি মারা গেলে মাথায় হাত পড়তো। আমার প্রতিটি মুরগিই নিয়মিত ডিম দিচ্ছে।
পবার রনহাটের সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে প্রায় ১ হাজার ২০০ মুরগি আছে। গত এক মাসে প্রায় ৩০টার মতো মুরগি মারা গেছে। এসব মুরগিকে বেশি শীতল রাখা যায় না, আবার বেশি গরমেও রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মুরগিগুলো মারা যাচ্ছে।
দিঘির পারিলা গ্রামের গবাদিপশুর ওষুধ বিক্রেতা সোহেল রানা বলেন, তীব্র এই গরমে সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে মুরগি। গরমের কারণে তারাই হিটস্ট্রোক করছে। খামারি বা স্থানীয়ভাবে যারা মুরগি পালন করছেন, তারা এসে ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন। একই অবস্থা গরু-ছাগলেও। তবে এখন পর্যন্ত এলাকায় কোনও গরু-ছাগল মারা যায়নি।
রাজশাহী পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, তীব্র এই দাবদাহে খামারের মুরগির ওজন কমে যাচ্ছে। মাংসের স্থিতি ৯৫ থেকে ৬০ শতাংশে চলে এসেছে। ৪০ দিনে একটি ব্রয়লার মুরগি দুই কেজি ওজন ছাড়িয়ে যায়। এখন তা ১ কেজিও হচ্ছে না। খামারিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সঠিকভাবে মুরগির পরিচর্যা করার জন্য।
পোলট্রি খামারিদের তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। এগুলো হলো, শেডে সঠিক বায়ু চলাচল নিশ্চিত করা, ধারণক্ষমতার মধ্যে কম মুরগি রাখা, পানিতে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার না করা, লেবু ও আখের গুড় দিয়ে দুপুরে শরবতের ব্যবস্থা করা, মুরগির শরীরে পানি স্প্রে করা, শেডের ছাদে ভেজা পাটের ব্যাগ রাখা এবং নিয়মিত পানি ঢালা, দুপুরে মুরগিকে খাবার খাওয়ানো যাবে না।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, প্রতিটি উপজেলায় আমাদের কর্মকর্তারা নিয়মিত খামারগুলো পরিদর্শন করছেন। নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এই তাপমাত্রায় মুরগি বাঁচানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, তবু চেষ্টা চলছে। ব্রয়লার মুরগি ৩৫ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। এরপর আর পারে না। মুরগির পালকের কারণে তারা এই তাপমাত্রা আরও সহ্য করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, ব্রয়লার মুরগি পালনে আদর্শ তাপমাত্রা হচ্ছে ২৫ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনেকে ফ্যানে বাতাস দিচ্ছে। দুপুরের দিকে এটা আরও বেশি প্রয়োজন।