রাজশাহীতে ভেঙে ফেলা হলো ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি
বাংলাদেশ

রাজশাহীতে ভেঙে ফেলা হলো ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি

রাজশাহীতে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নগরের ঘোড়ামারা মহল্লার মিয়াপাড়ায় এই বাড়ির আঙিনায় এখন ইটের স্তূপ পড়ে আছে। খবর পেয়ে বুধবার দুপুরে রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা ভিড় করেন বাড়িটিতে। এ সময় বাড়িটির পাশেই থাকা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চলচ্চিত্রকর্মীদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে। সম্প্রতি বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে গত ৬ ও ৭ আগস্ট ভেঙে ফেলা হয়েছে। 

কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঠিকাদার। তবে কলেজের অধ্যক্ষ বলছেন, তাদের সাবেক শিক্ষার্থীরা এটি ভেঙে ফেলেছেন।

জানা গেছে, ঋত্বিক ঘটক জীবনের শুরুর সময়টা রাজশাহীর এই পৈতৃক বাড়িতে কাটিয়েছেন। এখানে থাকার সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়েছেন। রাজশাহী কলেজ ও মিঞাপাড়ার সাধারণ গ্রন্থাগার মাঠে কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নাট্যচর্চা করেছেন। ওই সময় ‘অভিধারা’ নামে সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেন ঋত্বিক। তাকে ঘিরেই তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়। এই বাড়িতে থেকেছেন ঋত্বিক ঘটকের ভাইঝি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী।

এই বাড়ির পুরো ৩৪ শতাংশ জমি ১৯৮৯ সালে এরশাদ সরকার রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে ইজারা দেয়। কলেজটি বাড়ি ঘেঁষেই পশ্চিম পাশে রয়েছে। ২০১৯ সালে বাড়িটির একাংশ ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির অভিযোগ উঠেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তখন রাজশাহীসহ সারা দেশে প্রতিবাদ জানানো হয়। পরে ২০২০ সালে বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয় রাজশাহী জেলা প্রশাসন।

৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের ওপর দোষ চাপিয়ে হোমিওপ্যাথিক কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান পুরোনো স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন সাংস্কৃতিককর্মীরা।

বুধবার দুপুরে ঋত্বিক ঘটকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে বাড়ির কোনও চিহ্ন নেই। পুরো এলাকাজুড়ে পুরোনো ইটের স্তূপ পড়ে আছে। রাজশাহীর চলচ্চিত্রকর্মীরা দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে সেখানে জড়ো হন। কলেজ অধ্যক্ষের কাছে তারা জানতে চান, ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি কারা কীভাবে ভাঙলো। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ বলে, তারা জানে না; দুর্বৃত্তরা এটা ভেঙেছে। এ সময় চলচ্চিত্রকর্মী ও সাংবাদিকদের সঙ্গে কলেজ কর্তৃপক্ষের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সেখানে থাকা শ্রমিকেরা আজও বাড়ি ভাঙার কাজ করছিলেন। তারা জানান, তারা এখানে কলেজ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভাঙার কাজ করছেন।

কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান জানান, ৬ আগস্ট অফিস খোলার দিন তারা আসেন। তখন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এখানে আসেন। তারা বলতে থাকেন বঙ্গবন্ধুর ছবিটা নামিয়ে নিতে। তখন তারা ব্যানারগুলো নামিয়ে ফেলেন। শিক্ষার্থীরা তখন বলেন, এই জায়গাটা ভেঙে ফেলতে হবে। তখন তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এটা কেন ভেঙে ফেলতে হবে?’ পরে সেদিনের মতো শিক্ষার্থীরা চলে যান। পরে সেদিন রাত ৮টায় তিনি ফোনে জানতে পারেন, বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে। তখন এসে দেখেন, ছয় থেকে সাত জন শ্রমিক এটা ভাঙছেন। শ্রমিকরা তাকে জানিয়েছেন, কয়েকজন তাদের টাকা দিয়ে এটা ভাঙতে বলেছেন। ছাত্ররা এটা করিয়েছেন। তার ইন্ধনে এটা হয়নি। কারণ, জায়গাটা তারা হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোর হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান বলেন, এটা (ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি) সংরক্ষণের এখন তো আর কিছু নেই। এটা আউটডোর হিসেবে এখন কিছু করবেন। তখন সাংবাদিকরা বলতে থাকেন, ‘আপনাদের প্ল্যানেই এটা ভাঙা হয়েছে।’ তখন সেখানে ঠিকাদার শামীম মিয়াকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘আমরা ৫ তারিখে এসে দেখি, ছাত্ররা নাকি বাড়িটির সামনে একটি দেয়াল ভেঙে ফেলেছে। তখন কলেজের স্যাররা আমাকে ডেকে এনে বলেন এটা ভেঙে সরিয়ে দিন। তার পর থেকে আমি শ্রমিক নিয়ে এটা ভেঙেছি।

এরপর জেলা প্রশাসকের কাছে যান চলচ্চিত্রকর্মীরা। জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ তদন্তের জন্য এক সপ্তাহের সময় নিয়েছেন। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি)।

চলচ্চিত্রনির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম সাইক বলেন, রাজশাহীতে ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক এই নিবাসরে একাংশ ২০১৯ সালে ভেঙে সাইকেল গ্যারেজ করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। এবার তারা পুরোটাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এটা কোনোভাবেই মানবো না। এজন্য জেলা প্রশাসক দফতরে এসেছি।

গত ৬ ও ৭ আগস্ট ভেঙে ফেলা হয়েছে বাড়িটি

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, জেলা প্রশাসন এটা সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। পরে তারা ভূমি মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে তারা ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটি ইজারা থেকে অবমুক্ত করে ঋত্বিক ঘটকের নামে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। সেই চিঠিটা মন্ত্রণালয়ে আছে। চলচ্চিত্রকর্মীরা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে এসেছিলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্ত করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে। সেটি দেখা হচ্ছে। যারা এই বাড়ি ভাঙায় জড়িত থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা সংরক্ষণের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করবেন।

এদিকে, উন্নয়ন গবেষণাধর্মী যুব সংগঠন ‘ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’র সভাপতি মো. শামীউল আলীম শাওন ও সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সকালে ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়ি পরিদর্শনে যান। এরপর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠককালে চলচ্চিত্র নির্মাতা তাওকীর ইসলাম, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র সম্মাননার উৎসব পরিচালক শাহারিয়ার চয়ন, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহক ও গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবুসহ ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম সোসাইটির সদস্যবৃন্দ এবং চলচ্চিত্রকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

Source link

Related posts

মিয়ানমারে ফেরত গেলেন আরও ১৩৪ বিজিপি ও সেনাসদস্য

News Desk

চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে কয়েক জেলায় অনুসারীদের বিক্ষোভ

News Desk

প্রথম দিনে বন্ধ হলো কয়েকশ’ অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান

News Desk

Leave a Comment