বিগত সরকারের ১৫ বছরে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে রাজশাহী নগরীতে গড়ে ওঠে নানা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। এলাকায় এলাকায় তৈরি হয় ‘কিশোর গ্যাং’। নগর নিরাপত্তায় তারা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, রাজশাহী মহানগরের নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সিসি টিভি ক্যামেরাগুলোও এখন বন্ধ রয়েছে। এতেও বেড়েছে সড়কে নিরাপত্তাহীনতা।
বেপরোয়া কিশোর গ্যাংগুলো রাজশাহী মহানগরীতে এখনও প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে। হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি ও মাদক গ্রহণ ছাড়াও তারা চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। বিশেষত দ্রুতগতির বাইকে চেপে তারা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত ও হয়রানিও করছে তারা। নগরবাসীর মধ্যে এসব নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রুখতে গত কয়েক বছর আগে মহানগরীতে ৬ শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যের ডাটাবেজ তৈরি করেছিল পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। কিন্তু পুলিশের নজরদারির অভাব ও রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকার পরিবর্তনের পর আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠছে এসব অপরাধী চক্র। এতে বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা ও মাদক ব্যবসা।
কিশোর ছিনতাইকারীদের কারণে বিশেষ করে ভোরবেলা ও রাতের রাজশাহী আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এতে নগরবাসীর মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন আতঙ্ক। ভুক্তভোগী নগরবাসীর অভিযোগ— রাজশাহী মহানগরীর পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য আবারও দৃশ্যমান হচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই এসব কিশোর দলবেঁধে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সড়কে নেমে পড়ে। বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল রেসে লিপ্ত হচ্ছে। পথচারী নারীদের হয়রানি করছে। সুযোগ পেলে ছিনতাইও করছে। আর এদের হাতে থাকছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র।
রাজশাহী নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন। তিনি বলেন, ‘গত ১ অক্টোবর ভোরে আমি আমার মায়ের অপারেশনের জন্য ২০ হাজার টাকা নিয়ে লক্ষ্মীপুরের দিকে যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে বর্ণালি এলাকায় বাইকে করে তিন ছিনতাইকারী আমার ব্যাগ ধরে টান দেয়। আরেকটু হলে শারীরিকভাবেও বড় দুর্ঘটনা ঘটতো। ওরা ব্যাগ নিয়ে গেছে। ওইখানে টাকাসহ মূল্যবান ডকুমেন্টও ছিল।’ পরে সমস্যা হতে পারে এমন শঙ্কায় থানায় কোনও অভিযোগও করেননি এই গৃহবধূ।
আরেকজন মালিহা অন্তরা রায়দা। দু’দিন আগে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, ‘আমার জীবনে এরচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা আর কোনোদিন ঘটেনি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বন্ধগেট পার হয়ে সিটি বাইপাসের আগে আমার ব্যাগটা পাশ থেকে এক বাইকে তিনজন এসে টান দেয়। আমি ব্যাগটা খুব শক্ত করে ধরেছিলাম। আর ব্যাগের ফিতা শক্ত না হওয়ায় তা ছিঁড়ে যায়। যদি ব্যাগের ফিতা শক্ত হতো, টানের সঙ্গে আমিও পড়ে যেতাম।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘কয়েকদিন আগে নর্দার্ন মোড় থেকে আমার এক বান্ধবীর ব্যাগও ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।’
এদিকে, গত কয়েকদিন আগে রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানা এলাকা থেকে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করেছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) মতিহার থানা পুলিশ। আসামিদের বয়স ২৪-২৬ বছর। ধারণা করা হচ্ছে এরাও কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য।
এছাড়া দামকুড়া থানায় সম্প্রতি ছিনতাইয়ের পর অটোরিকশা চালককে ফিল্মি কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এখন ছিনতাই আতঙ্ক নগরবাসীর মনে।
গত ১৬ অক্টোবরও রাজশাহীর এক বৃদ্ধ রিকশাচালককে ছুরিকাঘাতে খুন করে রিকশা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। মহানগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালী বাজার সংলগ্ন এলাকায় সড়কের পাশে তার মরদেহ পাওয়া যায়। নিহতের নাম আলম (৬৫)। রাজশাহী নগরীর বড়বনগ্রাম মহল্লার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘটনাস্থলে আলমের রিকশাটি পাওয়া যায়নি। পুলিশ ও পরিবারের ধারণা, আলমের রিকশাটি নেওয়ার জন্য ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এসব অপরাধ চক্র, কিশোর গ্যাং রোধ ও ছিনতাই নির্মূলে আরএমপি কাজ করছে বলে জানানো হয়েছে।
যা বলছেন আরএমপি থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা
রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশরাফুল আলম বলেন, আমাদের দিনে ও রাতে ৪টা করে টহল টিম কাজ করছে। আমার যোগদান প্রায় মাসখানেক হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে ছিনতাইয়ের কোনও জিডি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। তারপরও কাগজপত্র দেখে বলা যাবে। আর কিশোর গ্যাংয়ের যে তালিকা ছিল তা চুরি হয়ে গেছে। আবারও নতুন করে কাজ করা হচ্ছে।
মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মালেক বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা একেবারে যে নাই, এমনটা না। এরইমধ্যে ২টা ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। অটোরিকশা উদ্ধার করা হয়েছে। আর আমাদের রাতে ৩টি এবং দিনে ৪টি টহল টিম কাজ করছে। কিশোর গ্যাং নিয়েও পূজা শেষে পুরোদমে কাজ শুরু হবে।
চন্দ্রিমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান বলেন, আমি গত মাসের ১৮ তারিখ যোগদান করেছি। এরমধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি হয়নি। আর রাতে আমাদের ২টি এবং দিনে ২টি টহল টিম কাজ করছে। কিশোর গ্যাং নিয়েও কাজ শুরু করেছি। ধীরে ধীরে তৎপরতা বাড়বে।
কাটাখালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মতিন বলেন, আমাদের এখানে ছিনতাইয়ের কোনও ঘটনা নেই। আর দিনে ও রাতে টহল টিম কাজ করছে। এটার নির্দিষ্ট কোনও সংখ্যা নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী ডিউটি দেওয়া হয়। আর কিশোর গ্যাংয়ের কোনও তালিকা আমাদের নেই। আপনাদের কাছে থাকলে আমাদের দিতে পারেন।
শাহমখদুম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম বলেন, আমি গত মাসের ১৭ তারিখ যোগদান করেছি। এখন পর্যন্ত ছিনতাইয়ের কোনও ঘটনা পাইনি। আর আমার থানায় রাত ও দিনে তিনটি করে টহল টিম কাজ করছে। কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা থানায় নেই। তবে আমি এটা নিয়ে কাজ শুরু করেছি।
এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিন আখতার বলেন, গত একমাসের মধ্যে আমার থানায় মোবাইল ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে কোনও ঘটনা নেই। আর আরএমপিতে কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা আমার হাত ধরেই তৈরি। বোয়ালিয়াতেই প্রায় ৩০০ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। অন্য থানাগুলো মিলিয়ে আরও দুই-আড়াইশো জনের তালিকা ছিল। এয়ারপোর্ট থানায় সে তালিকাটা দেখে জানাতে পারবো। তবে আমরা কাজ শুরু করছি।
পবা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, আমার থানায় কোনও ছিনতাইয়ের ঘটনা নেই। কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তালিকা নেই। তবে আমাদের উচ্চ পর্যায়ের যে নির্দেশনা আছে, সেটা অনুযায়ী কাজ করছি।
কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, আমি আসার পর কোনও ছিনতাইয়ের ঘটনা পাইনি। কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা সর্ম্পকেও জানা নেই। তবে আমরা কাজ করছি। আর রাতে-দিনে মিলিয়ে ৬টা টহল টিম কাজ করছে।
আরএমপির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বোয়ালিয়া। সাম্প্রতিক ছিনতাইয়ের ঘটনা এই থানা এলাকাতেই বেশি। এ বিষয়ে বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বোয়ালিয়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা তাজমুল ইসলাম বলেন, আমার এখানে যোগদান কয়েক দিন হলো। এরমধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা পাইনি। আর কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়েও কাজ শুরু হচ্ছে।
এদিকে, রাজশাহী নগরীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি সড়কের মোড়ে মোড়ে বসানো ছিল ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটে বসে এই ক্যামেরাগুলোর মাধ্যমেই গোটা শহরে নজর রাখা হতো। কিন্তু এখন এ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় অনেক সিসি ক্যামেরা দুর্বৃত্তরা ভেঙে ফেলেছে। অল্প কিছু সিসি ক্যামেরা থাকলেও এর ভিডিও দেখার কোনও ব্যবস্থা এখন নেই।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাইবার ক্রাইম ইউনিট চালুর পর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অবস্থান শনাক্ত করে প্রতিদিনই হারিয়ে যাওয়া কিংবা চুরি হওয়া বেশ কিছু মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হতো। সহজে অপরাধী এবং তাদের অবস্থান শনাক্ত করা যেতো। ফরেনসিক ল্যাবে ডিজিটাল ডিভাইস থেকে নানারকম তথ্য উদ্ধার করা হতো। এতে মামলার তদন্তেও গতি পেতো। সিসি ক্যামেরার কারণে শহরে চুরি, ছিনতাইও অনেক কমেছিল। বিশেষ করে রিকশা, অটোরিকশা কিংবা মোটরসাইকেল চুরি অনেকটাই বন্ধ হয়েছিল। আবার কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সহজেই অপরাধীকে শনাক্ত করা যেতো।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০২০ সাল থেকে প্রায় ৪০০ সিসি ক্যামেরা নগর নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলন দমনের সময়ে আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গুরুত্বপূর্ণ সিসি ক্যামেরাগুলো ভেঙে ফেলে। এছাড়া আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্তে সিসি ক্যামেরার ব্যবহার হওয়ার শঙ্কায় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররাও কিছু ক্যামেরা ভেঙে ফেলে। তবে আন্দোলনের প্রধান প্রধান এরিয়া বাদে যে ক্যামেরাগুলো ভাঙা হয়েছে, তা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের পরিকল্পনায় হয়েছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, নগর নিরাপত্তায় সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো ভালো ভূমিকা রাখছিল। দ্রুতই এটা চালু করা উচিত।
আরএমপি কমিশনার আবু সুফিয়ান জানান, সাইবার ক্রাইম ইউনিটের কর্মীরা আলাদা ছোট একটা অফিসে স্বল্প পরিসরে কাজ করছেন। এটা কবে আবার আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে, সেটা এখনই বলতে পারছি না। তবে আমরা আগে সিসি ক্যামেরাগুলো লাগাতে চাই। এ জন্য সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। তারা সাড়া দিলে দ্রুতই হবে। এছাড়া নগর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কাজ করছি।