কিছুদিন আগে গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে বরিশাল পলিটেকনিক রোড এলাকার বাসিন্দা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের সেকশন অফিসার জুয়েল মাহামুদের বাবার। চিকিৎসার জন্য শরণাপন্ন হন বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। তবে এরপর তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে নানান জটিলতার। তিনি খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছেন, শুধু বরিশাল নয়, পদ্মা সেতুর এপাড়ের ১১ জেলা ও খুলনাতেও ক্যানসারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি দেওয়ার জন্য কোবাল্ট-৬০ মেশিন নেই। বাধ্য হয়েই ক্যানসার রোগীদের ছুটতে হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। তবে সেখানেও সরকারি হাসপাতালে রোগীর ব্যাপক চাপ, থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সিরিয়ালে। সবমিলিয়ে জুয়েলের মতো অনেক স্বজনকেই ক্যানসারের চিকিৎসায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। প্রতিবছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। তবে এই রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখনও অপ্রতুল এবং একই সঙ্গে ব্যয়বহুল। তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা নেওয়ার কারণে রোগীদের একটি বড় অংশ প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার বাইরে থাকছেন।
জুয়েল মাহামুদ বাংলা ট্রিবিউনকে নিজের এই কঠিন সময়ের অভিজ্ঞতার তুলে ধরে বলেন, তিনি তার বাবার চিকিৎসার জন্য বরিশালের শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কেমো থেরাপি দিতে পেরেছিলেন। ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমো দেওয়ার ২১ দিনের মধ্যে রেডিওথেরাপি দিতে হয়। তাকে বিপাকে পড়তে হয়েছে রেডিওথেরাপি দিতে গিয়েই। কারণ থেরাপি নেওয়ার জন্য শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগে গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, থেরাপি কোবাল্ট-৬০ মেশিন অচল। তাদের পরে পাঠানো হয় ঢাকার মহাখালীতে, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখানে যাওয়ার পর সিরিয়াল পেয়েছেন, তবে সেটা করতে পারবেন ৮ মাস পর। কিন্তু থেরাপি দিতে হবে ২১ দিনের মধ্যে। সেখানে ওই কোর্স সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার প্রয়োজন। একই থেরাপি বেসরকারিভাবে দিতে গেলে ২ লাখ টাকার প্রয়োজন। এত টাকা ম্যানেজ করা সম্ভব না হওয়ায় ‘প্রভাবশালীদের সহযোগিতায়’ সিরিয়াল ২১ দিনের মধ্যে এনে থেরাপি দেওয়া হয়।
জুয়েল মাহমুদ জানান, শুধু তার বাবাই নন, ওই সময় রাজধানীর মহাখালীতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ তিনি দেখেছেন। মাসের পর মাস সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেকেই মারাও যান। কেউ এবার এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তাকে কেমো দেওয়ার অবস্থাও থাকে না। পরে বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে রোগীর মারা যাওয়ার অপেক্ষা করেন স্বজনরা। অথচ দেশের জেলা হাসপাতালগুলোতে এই মেশিন থাকলে দরিদ্র মানুষগুলো কিছুদিন হলেও সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতে পারতেন।
দেশে কম খরচে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য নির্ভর করতে হয় একটি প্রতিষ্ঠানের উপর, সেটি হলো জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই হাসপাতালেরও অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট। তাই সারা দেশ থেকে আসা রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। বাধ্য হয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশেষায়িত এই ক্যানসার হাসপাতালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোগীরা আসেন রেডিওথেরাপির জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই হাসপাতালে স্থাপিত চারটি মেশিন নষ্ট রয়েছে। বাকি দুই মেশিন দিয়ে এর আগে অপ্রতুল হলেও প্রতিদিন প্রায় ২০০ এর কিছু বেশি রোগীকে থেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। সেটিও গত ডিসেম্বরে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
প্রায় একইধরনের ভোগান্তিতে পড়েছিলেন ভোলার বাসিন্দা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. হাসান। তিনি বলেন, তার ছোট ভাই দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসারে আক্রান্ত। তার রেডিওথেরাপি দেওয়া প্রয়োজন। শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাদেরও পাঠানো হয় মহাখালীতে। কিন্তু সেখানে দীর্ঘ লাইন এবং ঢাকায় গিয়ে তার ভাইয়ের রেডিওথেরাপি দেওয়া তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে তার পরিবারের থাকা জমি ভাইয়ের পেছনে শেষ হয়েছে। এখন আত্মীয়স্বজনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যা সহযোগিতা পান তা দিয়ে কোনোভাবে ভাইয়ের চিকিৎসা করান।
রেডিওথেরাপি দিতে না পারায় তার ভাইয়ের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই মেশিন বরিশাল মেডিক্যালে নেই। এমনকি পদ্মা এপাড়ের ১১ জেলা এবং খুলনা হাসপাতালে খবর নিয়েছেন সেখানেও নেই। এ কারণে তার ভাইয়ের রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় সে মৃত্যুর দিতে চলে যাচ্ছে।
শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সামনে আসা একাধিক রোগীর স্বজন বলেন, তারা খবর নিয়েছেন, কবে নাগাদ মেশিনটি সচল হতে পারে। তাদের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মেশিনটি আর ঠিক হবে না। সরকার থেকে নতুন মেশিন দিলে তবেই রেডিওথেরাপি শুরু করা যাবে।
তারা বলছেন, এখন ঢাকায় মহাখালীতে গেলেও সিরিয়াল পড়ে সাত থেকে আট মাস পর। দেখা যাবে, ওই সময় আসার আগেই রোগী মারা গেছেন। বাধ্য হয়ে এখন চিকিৎসককে থেরাপির পরিবর্তে ওষুধ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, রেডিওথেরাপির কাজ ওষুধে হবে না। রেডিওথেরাপি দিতেই হবে।
সরকারিভাবে ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকায় গিয়ে বেসরকারিভাবে কেমো দিতে হচ্ছে ক্যানসার রোগীদের। তবে সেক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালে খরচ হচ্ছে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। সেই টাকার সঙ্কুলান নিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেক রোগীকে।
এমন এক রোগীর স্বজন মহসিন জামান বলেন, ‘গরীব রোগীদের দিক চেয়ে সরকার থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অন্তত একটি মেশিন দিতে পারে। এতে করে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার পর রোগী মারা গেলেও স্বজনদের দুঃখটা কমে। কিন্তু অর্থের অভাবে চিকিৎসা দিতে না পেরে আমার পরিবারের সদস্য মারা যাচ্ছেন, তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আবার ওই সদস্যের জন্য পরিবারের জমিজমা শেষ করলে অপর সদস্যরা কীভাবে বেঁচে থাকবেন, তা নিয়েও চিন্তার যেন শেষ নেই। পরিস্থিতি এখন এমন যে আমাদের ভাবনা হচ্ছে, দরিদ্র পরিবারে এ ধরনের রোগ দেওয়ার আগেই আল্লাহ যেন তার স্বাভাবিক মৃত্যু দেন। ক্যানসার হলে ওই মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পরিবারের সব শেষ করতে হয়। এতে করে পরিবারের অপর সদস্যরাও এর ভুক্তভোগী হন।’
এ ব্যাপারে শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি (অনকোলজি) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. আ ন ম মঈনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগের কোবাল্ট-৬০ রেডিওথেরাপি মেশিন ২০১৫ সাল থেকেই অচল হয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে মেশিনটি স্থায়ী অকেজো ঘোষণা করা হয়। এ কারণে গেলো ৯ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর রেডিওথেরাপি। বেশিরভাগ রোগী আর্থিকভাবে সচ্ছল না থাকায় তাদের পক্ষে বেসরকারিভাবে কিংবা ঢাকায় গিয়ে থেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে, পদ্মা সেতুর এপাড়ের ১১ জেলা এবং খুলনা হাসপাতালেও এ ধরনের কোনও মেশিন নাই। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র ভরসাস্থল শের-ই বাংলা মেডিক্যালে অনেকেই আসেন রেডিওথেরাপি দিতে। কিন্তু মন খারাপ করে চলে যেতে হয়। নতুন মেশিন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন-নিবেদন করা হলেও কোনও সাড়া মেলেনি। তারপরও চেষ্টা চলছে একটি কোবাল্ট-৬০ রেডিওথেরাপি মেশিনের।’
শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. একেএম মশিউল মুনীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারিভাবে দেশের চারটি হাসপাতালে কোবাল্ট-৬০ মেশিন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। আশা করা হয়েছিল, সেখান থেকে একটি মেশিন এ হাসপাতালেও আসবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও এ মেশিনটি খুবই প্রয়োজন। সেই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরকে অবহিত করা হয়েছে।
শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ক্যানসার হাসপাতাল হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করা যাচ্ছে ওই হাসপাতালে ক্যানসার রোগের সব ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে। এতে করে এ অঞ্চলের মানুষের বিশেষ করে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা স্বল্প টাকায় চিকিৎসা সেবা পাবে। তবে এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
পরিচালক বলেন, আপনাদের (গণমাধ্যমকর্মী) মাধ্যমে সরকারের কাছে আমার একটি আবেদন থাকবে। তা হচ্ছে রোগীদের জন্য ওষুধ বিনামূল্যে না দিয়ে ক্যানসারসহ বড় ধরনের রোগের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা দিলে রোগীর স্বজনদের অনেক উপকার হবে। এতে করে প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দরিদ্র সীমার নিচে নেমে যাচ্ছে; এটা আর হবে না।