বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৬০-১৭০ টাকা হলেও, তা ৪২৮ টাকায় কিনছে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিনগুণ বেশি দামে হাসপাতালের রোগীদের জন্য এই মুরগি সরবরাহ করছে সোনাম ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একইভাবে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি দামে সরকারি এই হাসপাতালে রোগীদের জন্য অন্যান্য খাবার সরবরাহ করছে আরও তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
খাবার সরবরাহের সুযোগে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে গত তিন বছর ধরে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ঘুরেফিরে বেশি দামে যাবতীয় পণ্য কেনার জন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তারা। তাদের বাইরে অন্য কেউ কাজ পায় না। এতে প্রতি বছর লুটপাট হয় সরকারের কয়েক কোটি টাকা। আবার রোগীদের যে মানের খাবার দেওয়ার কথা, তার চেয়েও নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয় প্রতিদিন। খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—মেসার্স সোনাম ট্রেডার্স, এআর ট্রেডার্স, প্রিমিয়াম ট্রেডার্স ও মেসার্স নুরাইজ ট্রেডার্স। চারটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান নগরীর ধাপ হাজীপাড়া এলাকায়।
মেসার্স সোনাম ট্রেডার্স
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ছাগলের মাংস, ব্রয়লাল মরগি, পাকিস্তানি কক মুরগি, রুই মাছ, মৃগেল মাছ, কাতল মাছ ও ডিম সরবরাহ করে আসছে মেসার্স সোনাম ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে রংপুরের বাজারে ছাগলের মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০-৮০০ টাকায়; একই মাংস ১১৭০ টাকা কেজিতে হাসপাতালে সরবরাহ করছে সোনাম ট্রেডার্স। একইভাবে ব্রয়লাল মুরগির কেজি সর্বোচ্চ ১৬০-১৭০ টাকা হলেও ৪২৮ টাকায়, কক মুরগির কেজি ৩৫০ টাকা হলেও ৭১৫ টাকায়, ফার্মের মুরগির ডিমের পিস ১২ টাকা হলেও ১৫ টাকা ৬০ পয়সায়, রুই মাছ ৩০০ টাকা হলেও ৬১১ টাকায়, মৃগেল মাছ ২০০ টাকা হলেও ৪৯৪ টাকায় এবং কাতল মাছ ৩৫০ টাকা হলেও ৫৮৫ টাকায় সরবরাহ করছে তারা।
এআর ট্রেডার্স
হাসপাতালে রোগীদের জন্য শাকসবজি ও ফল সরবরাহ করছে এআর ট্রেডার্স। বর্তমানে রংপুরের বাজারে সাগর কলার হালি ২৫-৩০ টাকা হলেও ৭১ টাকা ৫০ পয়সায় সরবরাহ করছে এই প্রতিষ্ঠান। একইভাবে মিষ্টি কুমড়ার কেজি সর্বোচ্চ ২০-২৫ টাকা হলেও ৫২ টাকায়, বরবটির কেজি ৩০ টাকা হলেও ৬৫ টাকায় সরবরাহ করছে তারা। সেইসঙ্গে মৌসুমি শাকসবজি ও ফল বাজার দরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রিমিয়াম ট্রেডার্স
একই হাসপাতালে চাল-ডাল, আলু, আটা, তেল, চিনি, আদা-রসুন ও পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বাজার দরের চেয়ে দ্বিগুণ দামে সরবরাহ করছে প্রিমিয়াম ট্রেডার্স। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বর্তমানে বাজারে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৬৯ টাকা হলেও ২৩০ টাকায় সরবরাহ করছে তারা।
মেসার্স নুরাইজ ট্রেডার্স
হাসপাতালে প্রোটিন জাতীয় খাবার সরবরাহ করছে নুরাইজ ট্রেডার্স। এর মধ্যে গুঁড়ো দুধের কেজি এক হাজার ৯২ টাকা এবং হরলিক্স ৫৮৫ টাকায় সরবরাহ করছে তারা। এছাড়া মিষ্টি ও দই নগরীর বাজারের দরের চেয়ে বেশি দামে সরবরাহ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব বিষয়ে জানতে খাবার সরবরাহকারী এই চার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ নিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খাবার সরবরাহের কাজ পাচ্ছে এই চার প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। তাদের বাইরে কোনও প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারে না।
হাসপাতালের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন পণ্য বেশি দামে সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। এজন্য প্রতি বছর দরপত্রে অন্য প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দর দিয়েও কাজ পায় না। অনেক সময় টেন্ডার আহ্বানের কথাও কেউ জানে। গোপনে টেন্ডার ডেকে কাজ দেওয়া হয়। আবার যে মানের খাবার সরবরাহের কথা তার চেয়েও নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয় রোগীদের।
রোগী কম হলেও বেশি দেখিয়ে খাবারের বিল
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে প্রতি বছর খাবার সরবরাহের দায়িত্ব পাচ্ছে ওই চার প্রতিষ্ঠান। বাজার দরের চেয়ে খাবারের দাম বেশি দেখিয়ে সরকারি অর্থ ভাগ করে নিচ্ছেন তারা। প্রতি বছর এই লুটপাট চলছে। আবার রোগী কম হলেও বেশি দেখিয়ে খাবারের বিল করা হয়। বরাদ্দকৃত দুধ, ডিম ও ফলসহ পুষ্টিকর খাবার রোগীদের না দিয়ে বিল দেখানোর ঘটনা নিত্যদিনের। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসে ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তখন তিনি বলেছিলেন, “এই হাসপাতালে রোগীদের খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হবে।” ওই সময় কয়েকজনকে বদলি করা হলেও এখন পর্যন্ত রোগীদের খাবার দেওয়াতে কোনও পরিবর্তন হয়নি।’
যা বললেন হাসপাতালের পরিচালক
সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. ইউনুছ আলীর কার্যালয়ে দুই দিন দেখা করে গেছেন এই প্রতিনিধি। কিন্তু ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। দ্বিতীয় দিন হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে পরিচালক বলেন, ‘কোন বিষয়ে কথা বলতে হবে, তা আগে আমাকে জানাতে হবে।’ তৃতীয় দিন ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলতে চেয়ে পরিচালকের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান প্রতিনিধি। ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে বেশি দামে হাসপাতালে খাবার সরবরাহের ব্যাপারে জানতে চাইলে ডা. ইউনুছ আলী বলেন, ‘বলেছেন, ডেঙ্গু চিকিৎসা নিয়ে কথা বলবেন; এর মধ্যে খাবার সরবরাহের প্রশ্ন তুলছেন কেন? এ নিয়ে পরে কথা বলবো। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমি এখানে যোগ দেওয়ার পর রোগীদের খাবার নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি অনেকটাই কমিয়ে এনেছি।’
প্রতি বছর একই ঠিকাদার খাবার সরবরাহের দায়িত্ব কীভাবে পাচ্ছেন জানতে চাইলে ক্ষুব্ধ হন পরিচালক। তিনি বলেন, ‘তা আমি জানি না। হাসপাতালে দরপত্র ক্রয় কমিটি আছে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সবকিছু মূল্যায়ন করেই ঠিকাদারদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।’