ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের ওষুধ কেনার পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও প্রাইভেট হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে করাতে হয়। হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক রোগীদের প্রাইভেট ল্যাবে পাঠান। এজন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান তারা। এতে রোগীদের নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের ভেতরে রয়েছে প্যাথলজিক্যাল যেকোনো টেস্ট করানোর ল্যাব, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ। যেখানে রোগীদের সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে রোগীদের বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়। আবার হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক-নার্স অনৈতিক সুবিধা নিয়ে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট হাসপাতালে পাঠান।
নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার দরবেশপুর গ্রামের কৃষক মাইন উদ্দিন (৭০) কিডনি ও হার্টের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি হন গত ১৬ নভেম্বর। ভর্তির পর চিকিৎসক সিটি স্ক্যান, বুকের এক্স-রে, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, রক্তের ইলেকট্রোলাইট, ইকো-কার্ডিওগ্রাম পরীক্ষা করানোর জন্য বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ল্যাবএইড ও সিরামে পাঠান। এসব পরীক্ষা করাতে তার খরচ হয় ১২ হাজার টাকা। এতে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন তিনি।
মাইন উদ্দিনের স্ত্রী হালিমা খাতুন (৬০) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সুদের ওপর ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে হাসপাতালে স্বামীকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করি। চিকিৎসকের পরামর্শে বাইরের ল্যাবে পরীক্ষা করাতে ১২ হাজার টাকা খরচ হয়। সরকারি এই হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে পারলে এত টাকা খরচ হতো না। এখানে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হলে আমাদের মতো গরিব রোগীদের ভোগান্তি কমতো। কষ্ট দূর হতো।’
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে একই হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হন ফুলপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের হযরত আলী (৬০)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। তাকে হাসপাতালের সিসিইউ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তার বুকের এক্স-রে, মাথার সিটি স্ক্যান ও বেশ কিছু পরীক্ষা করানোর জন্য পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান। এসব পরীক্ষা করাতে গিয়ে হযরত আলীর খরচ হয় সাড়ে সাত হাজার টাকা।
সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগীদের পরীক্ষা করাতে বাইরে পাঠানো হয় পকেট কাটার জন্য অভিযোগ করে হযরত আলী বলেন, ‘হাসপাতালে ভেতরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি থাকলেও চিকিৎসক আমাকে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দিলেন। এতে করে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এগুলো রোগীদের পকেট কাটা ছাড়া কিছুই নয়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা করাতে পারলে গরিব রোগীদের উপকার হতো।’
সার্জারি ওয়ার্ডের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক রোগীর স্বজন আজিজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতালে প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগসহ সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকার পরও কিছু চিকিৎসক-নার্স রোগীদের প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। এজন্য চিকিৎসক-কর্মচারীরা প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান। এ কারণেই তারা সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা না করিয়ে রোগীদের বাইরের প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।’
হাসপাতালের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এই হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কর্মচারীদের সঙ্গে মিলে কমিশন বাণিজ্য ধার্য করেছেন। মাস শেষে তাদের কমিশন দেওয়া হয়। এ কারণে সব ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে থাকা সত্ত্বেও প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীদের পরীক্ষার জন্য পাঠান চিকিৎসক। এ ধরনের অনৈতিক কাজে সব চিকিৎসক জড়িত তা বলা যাবে না। কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স ও কর্মচারী মিলে এই কাজটি করছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের ২ নম্বর ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. খুরশেদুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি থাকার পরও রোগীদের প্রাইভেট ল্যাবে পাঠানো সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ। এ ধরনের কাজে সরকারি চিকিৎসকদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।’
রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রাইভেট ল্যাবে পাঠানোর বিষয়টি শুনেছেন বলে জানালেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) চিকিৎসক মাইন উদ্দিন খান। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছে। এরপরও কোনও চিকিৎসক রোগীকে বাইরে পরীক্ষার জন্য পাঠালে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আরও পড়ুন:
৩০০ টাকা খরচ করে ৪৫ টাকার সরকারি ওষুধ পেলাম