গরুর মাংস। প্রাণিজ এই আমিষ কখনও কখনও দেহঘড়ির বাজায় বারোটা! সেটা সবারই জানা। সুস্বাস্থ্যের জন্য চিকিৎসকের প্রথম পরামর্শই থাকে, লাল এই মাংস কোনোভাবেই যেন খাবারের থালায় না ওঠে। তারপরও বাজারে গেলে গরুর মাংসের দিকেই থাকে ক্রেতার চোখ। আর রমজান এলে গরুর মাংসের চাহিদা বাড়ে কয়েক গুণ। সেই সুযোগে দামের চরকি চড়তেই থাকে।
প্রচলিত ধারা মেনে এবারের গরুর মাংস বাজারের ছবিটাও একই। রমজান আসতে এখনও বাকি এক মাসের বেশি সময়। এর মধ্যেই ব্যবসায়ীরা শুরু করে দিয়েছেন দাম বাড়ানোর ‘অনুশীলন’।
খোদ সরকারি বিপণন সংস্থার (টিসিবি) তথ্যই বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৫.১৭ শতাংশ। আর সমকালের এই প্রতিবেদক গরুর মাংসের বাজার ঘুরে টিসিবির এই হারের চেয়েও বেশি দাম বাড়ার তথ্য পেয়েছেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজারেও ছিল একই দর, যা কয়েক দিন আগেও কেনা যেত ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে।
প্রতিবছর রমজান শুরুর আগে সিটি করপোরেশন গরু মাংসের দাম বেঁধে দেয়। বিক্রেতারা সেই দরও কোনো সময় মানতে চান না। সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, রমজানে সিটি করপোরেশন গরুর মাংসের দর নির্ধারণ করার আগেই ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে দাম বাড়িয়ে রেখেছেন।
দেশে চাহিদার তুলনায় প্রতিবছরই উৎপাদন বাড়ছে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার। ফলে উদ্বৃত্তের পরিমাণও বেশি। ভোক্তাদের অভিযোগ, অন্য নিত্যপণ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাংসের দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া সামনে রমজান। এই মাসে চাহিদা থাকে বেশি। এসব কারণে আগে থেকেই দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে, দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা দাঁড় করাচ্ছেন নানা যুক্তি। সামনে রমজান। এখনও সরকারের সংশ্নিষ্ট কেউ এই পণ্যটি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। যারা ভারত থেকে মাংস আমদানি করে, তারা বাজারে মাংস বিক্রি না করে মজুত করে রাখে। বাজারে যখন দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখনই বিক্রি করে। অন্য সময় ওই মাংসগুলো হিমাগারে সংরক্ষণ করে রাখে। তা ছাড়া বর্তমানে গরুর দামও বাড়ছে।
সরকারি তথ্য: প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পশু উৎপাদন হয়েছে পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় চার লাখ বেশি। এর মধ্যে রয়েছে গরু ৪৪ শতাংশ ও ছাগল ৪৫ শতাংশ। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, গত অর্থবছরে গরু উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ। তার আগের বছর ছিল দুই কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার। সে হিসাবে গরুর উৎপাদন বেড়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার।
চাহিদার চেয়ে মাংসের উৎপাদনও বেড়েছে। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে জনপ্রতি দৈনিক মাংসের চাহিদা ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা দাঁড়ায় ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন হয়েছিল ৮৫ লাখ ৪১ হাজার টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত ছিল ১১ লাখ চার হাজার টন।
ক্রেতারা যা বলছেন: রাজধানীর তেজকুনিপাড়া থেকে আধা কেজি মাংস কিনেছেন হামিদা বেগম। বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চলে এই নারীর। তিনি বলেন, ‘আধাকেজি গোশত আজ ৩৩০ টাকা নিয়েছে। মাসখানেক আগেও এই দোকান থেকেই আমি ৩০০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম।’
কারওয়ান বাজারে মাংস কিনতে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন সরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘এক এক করে সব জিনিসের দাম বাড়ছে। রমজান শুরুর আগেই দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারি চাকরিজীবী হয়ে আমরা বাজারে এসে যে পরিস্থিতি দেখি তাতে সহজে অনুমান করা যায়, স্বল্প আয়ের মানুষ কতটা কষ্টে আছেন।’
যা বলছেন ব্যবসায়ীরা: গাবতলী মাংস ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী সভাপতি কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, করোনার কারণে এত দিন সামাজিক-পারিবারিক অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে মানুষ। ফলে মাংসের চাহিদা বেড়েছে। অন্যদিকে কোরবানি ঈদকে টার্গেট করে খামারিরা এখন থেকেই ব্যাপারিদের কাছ থেকে গরু কিনে মোটাতাজা করছেন। তারা সেগুলো বাজারে ছাড়ছেন না বলে সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে একেকটি গরুর দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। গরুর খাদ্যের দামও বেড়েছে। ১৫ থেকে ২০ টাকার এক কেজি ভুসি এখন কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। চার থেকে পাঁচ টাকার এক আঁটি খড়ের দাম ৪০ টাকা। এসব কারণে গত কোরবানির পর মাংসের কেজি ৬০০ টাকায় বিক্রি করলেও এখন সেই দামে বিক্রি করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।
ভারত থেকে গরু আমদানি না হওয়ার কারণে মাংসের দাম বাড়ছে বলে মনে করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি ও ফকিরাপুলের মাংস ব্যবসায়ী গোলাম মর্তুজা মন্টু। তিনি বলেন, সীমান্ত দিয়ে বৈধ উপায়ে আমদানি করতে হবে জীবিত গরু। যেহেতু বাংলাদেশে মাংসের চাহিদা বেশি, তাই প্রয়োজনে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করে গরু আমদানি করতে হবে। ব্যাংকে এলসি খোলার মাধ্যমেও গরু আমদানি করা যেতে পারে।
ভারত থেকে প্রক্রিয়াজাত মাংস আমদানি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুলো মাংস নয়, মাংসের নামে বিষাক্ত পণ্য আসছে। যে গরুর মাংস আসছে দেশে, সেই গরু কত দিন আগে জবাই হয়েছে, হালাল উপায়ে জবাই করা হয়েছে কিনা তা আমদানিকারকরা জানে না। ওই মাংসগুলো হিমাগারে রেখে বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়। সেগুলোর দাম অনেক কম। প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় পাওয়া যায়। সাধারণত হোটেল-রেস্টুরেন্টের মালিকরা এসব মাংস কেনেন।
আমদানিকারকদের মাংস হিমাগারে রাখার সুযোগ বন্ধ ও উৎপাদন বাড়ালে মাংসের দাম কমানো সম্ভব বলে মনে করেন বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি বলেন, মাংসের বাজার দেখভাল করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকার, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের হলেও তারা সেভাবে তদারকি করছে না। আগে একটা গরু জবাই হলে সেই মাংস ওই দিনই বিক্রি করতে হতো ব্যবসায়ীদের। যখন আমদানি বাড়ল, হিমাগারে রাখার সুযোগ তৈরি হলো তখন থেকেই মাংসের বাজারে অস্থির। তবে দেশের চরাঞ্চল পশু উৎপাদনের কেন্দ্রে পরিণত করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে মাংস রপ্তানি করা যাবে। তখন দামও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তিনি দাবি করেন, সরকার গরু আমদানি ও হাটে চাঁদাবাজি বন্ধ আর উৎপাদনের উদ্যোগ নিলে আগামী দুই বছরের মধ্যেই মাংসের কেজি ৩০০ টাকায় নামিয়ে আনা সম্ভব।
ডিজি বলছেন পশুখাদ্যের দাম কমবে: পশুখাদ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, মাংসের দাম বাড়ায় আমাদের দায় আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ এখন মাংসজাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে এখন পশুখাদ্যের দাম বেশি। কীভাবে খাদ্যের দাম কমানো যায়, সে ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আশা করা যায়, অচিরেই ভালো সংবাদ আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, নতুন যেসব চর জেগে ওঠে, সেগুলোতে পশুর উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়- সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।