কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে এই দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। অবশ্য অবশেষে আরসা-আরএসও সন্ত্রাসী থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে থাকা তিনটি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতদিন রোহিঙ্গা নেতারা আরসা-আরএসও ক্যাম্পে থাকার বিষয়টি বলে এলেও আর্মড পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এদের ‘পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ বলে আসছিলেন।
ক্যাম্পে থমথমে অবস্থা
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, সর্বশেষ উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) আরএসও ও আরসার মধ্যে গোলাগুলিতে পাঁচ জন নিহত হন। তারা আরসার সদস্য। এ ঘটনায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ক্যাম্পে। ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রকাশ্যে চলছে তাদের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের জেরেই ঘটছে হত্যাকাণ্ড। বর্তমানে বেশি তৎপর আরসা ও আরএসও এবং নবী হোসেন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণই দ্বন্দ্বের মূল কারণ। ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আরএসও এবং আরসা সন্ত্রাসীরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। অপহরণ আতঙ্কে অন্তত ৩০ জন মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ক্যাম্প-৮ ছেড়ে আশপাশের ক্যাম্পে আত্মগোপন করেছেন।
আরসা-আরএসও ক্যাম্পে অস্ত্রের মহড়া দেয়
ক্যাম্পের একাধিক মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আরসা এবং আরএসও সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পে ঢুকে অস্ত্রের মহড়া দেয়। প্রায় দিনই রোহিঙ্গাদের ঘরে ঢুকে নারী-পুরুষদের অত্যাচার-নির্যাতন করে লুটপাট চালায়। এমন পরিস্থিতিতে নির্ঘুম রাত কাটছে তাদের। তবে এপিবিএন ক্যাম্পে অভিযান চালালে বিভিন্ন আস্তানা ও পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয় সন্ত্রাসীরা। অভিযান শেষ হলে রাতে কাঁটাতারের বেড়া কেটে ক্যাম্পে ঢুকে অপকর্ম শুরু করে তারা।
সর্বশেষ সোমবার (১০ জুলাই) ভোরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্মড পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে মো. হুসেন মাঝি নামে আরসার এক শীর্ষ নেতা নিহত হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি, ওয়াকিটকি, মোবাইল ও একাধিক মোবাইল সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এপিবিএন।
১৭৫টি হত্যাকাণ্ড
জেলা পুলিশ ও এপিবিএনের তথ্যমতে, কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত সাড়ে পাঁচ বছরে ১৭৫টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে চলতি বছরের সাত মাসে (১০ জুলাই পর্যন্ত) একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১২ জন আরসার সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা।
আরসা-আরএসওর মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পের একাধিক মাঝি জানিয়েছেন, ক্যাম্পে আরসা-আরএসওর মধ্যে বর্তমানে বিভেদ চরমে। উদ্দেশ্য নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনির গ্রুপ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে অন্য একটি অংশ। এই অংশকে নিজেদের দলে ভেড়াতে চাইছে আরএসও। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। এ ছাড়া রয়েছে ক্যাম্পের ত্রাস নবী হোসেন গ্রুপ। আবার ক্যাম্পের অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও আরসা সন্ত্রাসী দলের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে গোপনে আরএসওকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এদের যুক্তি আরএসও ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখতে চায়। বাস্তবে দুটি গ্রুপই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত।
যা বলছে পুলিশ
কতদিন ধরে আরএসও এবং আরসা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় জানতে চাইলে ১৪-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) সৈয়দ হারুন উর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ক্যাম্পে সক্রিয়। তবে সম্প্রতি তাদের দ্বন্দ্ব ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। আজ আরসার এক শীর্ষ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। আমরা কোনও সন্ত্রাসী গ্রুপকে ছাড় দিচ্ছি না। ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখতে আমাদের যৌথ অভিযান চলছে। তাদের ধরার অভিযানের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
আরএসও এবং আরসার মধ্যে মূলত কী নিয়ে দ্বন্দ্ব ও খুনোখুনি জানতে চাইলে ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমির জাফর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে তারা। আরএসও এবং আরসা; দুটিই সন্ত্রাসী গ্রুপ। জেলা পুলিশ, র্যাব এবং এপিবিএনের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চলছে। সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রয়োজনে ক্যাম্পজুড়ে বিশেষ যৌথ অভিযান চালানো হবে। কেউ রেহাই পাবে না, সবাইকে ধরা হবে।’
তবে আরএসও এবং আরসা প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে-খুনোখুনিতে জড়ালেও তাদের এখনও পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলছেন ১৬-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) হাসান বারী নুর। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে আরএসও এবং আরসা নেই। অনেকে আরএসও এবং আরসার নাম বলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। তারা মূলত পাহাড়ি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এরা মাদক ব্যবসা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। তাদের শক্তভাবে দমন করছি আমরা। ক্যাম্প আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’