রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এবারও ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন। একই আসনে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ অবস্থায় নৌকা প্রতীকের বাদশাকে বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতানোর অঙ্গীকার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে নৌকা পেলেও এবার জেতা কঠিন হবে ফজলে হোসেন বাদশার—এমনটি বলছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ভোটাররা।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-২ (সদর) আসন। এই আসনে দুই বাদশার লড়াই এবার নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলেছে। নৌকার ভোটাররা একটু বেঁকে বসলেই ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশার পরাজয় ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) বিকালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশার হাত উঁচিয়ে তাকে জেতানোর অঙ্গীকার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে ভোটব্যাংক না থাকা জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেনের জয় নিশ্চিত করাটা কঠিন হয়ে গেলো। কারণ শফিকুর রহমান বাদশা আওয়ামী লীগের বড় একটা অংশের সমর্থন পেয়ে গেছেন।
এ ব্যাপারে ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, প্রার্থী দেখে নয়, মানুষ নৌকা প্রতীক দেখে আমাকে ভোট দেবে। আমি বিগত সময়ে এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছি। তার প্রতিফলন ভোটে ঘটবে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা ২০০৮ সালে ১৪ দলের প্রার্থী হয়ে প্রথমবার এই আসনের এমপি হন। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে জোটের প্রার্থী হয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও একইভাবে নৌকায় উঠে নির্বাচনের বৈতরণী পার হন। প্রতিবারই নিজের দলীয় প্রতীক হাতুড়ি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। রাজশাহীতে ওয়ার্কার্স পার্টির ভোটব্যাংক না থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়েই তিনি এমপি হন। কিন্তু এমপি হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখেননি এমন অভিযোগ নেতাদের। এছাড়া এই আসনের উন্নয়নে বাদশার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের।
দলীয় নেতারা বলছেন, এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথমে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালকে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পর তাকে নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা আনন্দ মিছিল করেছিলেন। ১৪ দলের মনোনয়ন ঘোষণার পরে মোহাম্মদ আলীকে বাদ দিয়ে সেই নৌকা ফজলে হোসেন বাদশাকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ইতোমধ্যে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেছেন ফজলে হোসেন। সেখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ডাকা হয়নি, এমনকি তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিয়ে দেন তারা। ফলে নৌকা পেলেও স্বস্তিতে নেই ফজলে হোসেন বাদশা।
এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল বলেন, আমরা নৌকার পক্ষে, দলের কেউ নৌকার বিপক্ষে নই। সব সময় নৌকার জন্য কাজ করছি। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নৌকার জন্য কাজ করছেন। কিন্তু ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক পেয়ে আমাদের নেতা খায়রুজ্জামান লিটনকেই যদি সভা-সমাবেশে না ডাকেন, তাহলে কী আমাদের ঠেকা পড়েছে যে, তার বাসায় গিয়ে নৌকার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করায় এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতানোর জন্য মাঠে নেমেছি আমরা।
নৌকার প্রার্থীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, আমাকে যেখানেই ডাকা হয়, সেখানেই যাই। কিন্তু নৌকার প্রার্থী আমাকে নির্বাচন করার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি। এখন আমরা যদি দলীয় নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে দলের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিই, তাহলে অপরাধ হবে না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে না। এজন্য যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জবাব দিতে হয়, তাহলে সেই জবাব আমি দেবো। সেই জবাব দেবেন খায়রুজ্জামান লিটন। আমরা যখন মাঠে নেমেছি, তখন শফিকুর রহমানকে বিজয়ী করে আনবো। তবে আমরা নৌকার বিপক্ষে নই, ফজলে হোসেন বাদশার বিপক্ষে। তাকে আমরা দেখিয়ে দেবো, রাজশাহীতে তার কোনও জনসমর্থন নেই।
মোহাম্মদ আলী কামাল আরও বলেন, ‘আজ দুই বছর হয়ে গেলো আমি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি। পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও ফোন দেননি ফজলে হোসেন বাদশা। বারবার তিনি নৌকা পেয়ে যান। তিনবার থেকেই গেলেন। চতুর্থবারের মতো তাকে নৌকা দেওয়া হলো। এই দুঃখ আমরা কাকে বলবো। আমাদের ভাগ্যের দোষ। আওয়ামী লীগ এবার দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। তাই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আমরা সমর্থন জানিয়েছি।’
গত তিন নির্বাচনের মতো এবারও নৌকা ছিনতাই হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা। তিনি বলেন, আমার লড়াইটা হবে নৌকা মাঝি পাল্টানোর। যিনি এই আসনে নৌকা পেয়েছেন তিনি প্রকৃত মাঝি নন। বাধ্য হয়ে আমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কেউ এই আসনে মনোনয়ন পেলে নেতাকর্মীরা চাঙা থাকতেন। তাদের মনে কষ্ট থাকতো না। স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন নিয়েই মাঠে নেমেছি। শিক্ষাবিদ হিসেবে নিজের জয়ের ব্যাপারেও শতভাগ আশাবাদী আমি। কারণ আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় দলটির কর্মী-সমর্থকরা আমাকেই ভোট দেবেন।’
তবে ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ‘মানুষ নৌকা প্রতীক দেখে আমাকে ভোট দেবে। জনগণের অংশগ্রহণ যদি বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত যে প্রতিক্রিয়া, তাতে মনে হচ্ছে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। মাঠের অবস্থা এবার আগের চেয়েও ভালো, আশা করছি এবারও জয়ী হবো।’