লিবিয়া গিয়ে যেভাবে মাফিয়াদের থেকে ছেলেকে উদ্ধার করলেন বাংলাদেশি নারী
বাংলাদেশ

লিবিয়া গিয়ে যেভাবে মাফিয়াদের থেকে ছেলেকে উদ্ধার করলেন বাংলাদেশি নারী

সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ার মাফিয়াদের হাতে আটক সন্তানকে অদম্য সাহসিকতায় উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে গিয়ে উদ্ধার করে এনেছেন কুমিল্লার এক নারী। শুধু তাই নয়, লিবিয়ার মাফিয়াদের হাত থেকে ২৫০ বাংলাদেশি বন্দিকে উদ্ধারে সহায়তা করেছেন তিনি। তার এমন সাহসিকতায় কুমিল্লাসহ দেশজুড়ে চলছে আলোচনা।

জানা গেছে, বসতভিটার একটি অংশ বিক্রি করে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার শাহিনুর বেগম। স্বপ্ন দেখেছিলেন, ছেলের রোজগারে সংসারের অভাব ঘুচাবেন। তবে সেই স্বপ্ন দ্রুতই ভেঙে যায়। অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে আটক হন একমাত্র ছেলে ইয়াকুব। তারপর অপেক্ষা করতে করতে ছয় মাস কেটে যায়। তবু ছেলের খোঁজ পান না শাহিনুর বেগম। পরে পাগলপ্রায় হয়ে সিদ্ধান্ত নেন লিবিয়ায় গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে আনবেন। যেই কথা সেই কাজ। জানুয়ারিতে সাত হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে চলতি বছরের ২১ মার্চ কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার নিজ গ্রাম কালিকাপুরে ফেরেন তিনি।

শাহিনুর বেগম জানান, তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। স্বামী লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। চাচাশ্বশুরের কাছে বসতভিটার একটি অংশ বিক্রি করে ২০১৯ সালে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। সেখানে গিয়ে তেলের কোম্পানিতে কাজ শুরু করে সন্তান। তার স্বামী ও ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে যে টাকা পাঠাতো তা দিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। 

তিনি জানান, ঘটনার মোড় নেয় ২০২১ সালের শুরুতে। তখন ছেলে মোবাইলে তাকে বলে অবৈধপথে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাবে। সেখানে ভালো অর্থ আয় করতে পারবে। এরপর জাহাঙ্গীর নামে এক দালালকে চার লাখ টাকা দিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। কোস্টগার্ড তাকে ২২ দিন আটকে রাখে। চার লাখ টাকা দিয়ে কোস্টগার্ডের কাছ থেকে সন্তানকে ছাড়িয়ে আনেন বাবা আবুল খায়ের। এ ঘটনার আট মাস পর ইয়াকুব আবারও স্বপ্ন দেখে অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার। সেই স্বপ্নই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। ইতালির পথে মাফিয়ারা আটক করে তাকে। এরপর থেকেই ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় মায়ের।

ইয়াকুব বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাকে আটক করে মোবাইল ও টাকা-পয়সা সব রেখে দেয়। এ সময় সেখানে আমাকেসহ প্রায় ৩০০ জনকে মাটির নিচে একটি ছোট অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখে। সেখানে আমার সঙ্গে থাকা অনেকেই মারা গেছেন। তাদের লাশ টেনে টেনে বাইরে ফেলে দিতো। তখন আমরা ভয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম। তারা আমাদের কাঁদতেও দিত না। কাঁদলেই মারধর করতো। খাবারের অভাবে সবাই দুর্বল হয়ে পড়ে। মাফিয়াদের কাছে অনেক আগে আটক হওয়া সাত বাঙালি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতো। তারা আমাদের অনেক মারধর করতো। মাফিয়ারা বলেছিল, আমাদের ঠিকমতো শাসন করতে পারলে তাদের ছেড়ে দেবে। তাই তারা কথায় কথায় মারতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘মারধরের ক্ষত ও পোকামাকড়ের কামড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন ধরে। ৩০০ জনের জন্য ৩০০ রুটি দিলে সেই সাত বাঙালি প্রায় ৩০-৪০টি রুটি রেখে দিতো। বাকি রুটি আমরা ভাগ করে খেতাম। মাফিয়ারা বাঙালি দালালের মাধ্যমে জিম্মি করার বিষয়টি সবার পরিবারকে জানায়। ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে পরিবার থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েও ছাড়তো না। তখন শত চেষ্টা করে কারও সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। বসে বসে মা-বাবার কথা মনে করে কানতাম।’

মা শাহিনুর বেগম বলেন, ‘প্রায় ছয় মাস ছেলের সন্ধান না পেয়ে পাগলের মতো হয়ে যাই। লিবিয়ায় আমার স্বামী আবুল খায়ের ছেলের শোকে স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দালালদের টাকা দিয়েও আমার ছেলেকে পাওয়ার কোনও উপায় পাচ্ছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নিই ছেলের খোঁজে লিবিয়া যাবো। তখন গ্রামবাসী বলতো, আমার ছেলে মারা গেছে। আরও কত কথা। আমার মন বলতো আমার ছেলে বেঁচে আছে। তাই কুমিল্লা গিয়ে আমি নিজে পাসপোর্ট করি। তারপর ভিসা ও প্লেনের টিকিট সংগ্রহ করি।’

তিনি বলেন, ‘এ বছরের ৮ জানুয়ারি লিবিয়ায় রওনা হই। ছেলের চিন্তায় আমি বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন বিমানবালারা আমাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখেন। তারা আমাকে অনেক সাহায্য করেন। প্রথমে দুবাই যাই। মাথায় শুধু একটা চিন্তা- এত টাকা খরচ করে লিবিয়া যাচ্ছি, সেখানে গিয়ে ছেলেকে কীভাবে খুঁজবো। কিছু বাঙালির সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনঘাজিতে স্বামীর কাছে যাই। তখন আমার স্বামী খুব অসুস্থ ছিল। তাই নিজেই ছেলের খোঁজে বের হয়ে পড়ি।’

ছেলে ইয়াকুব বলেন, ‘কয়েক মাস চেষ্টা করার পর আমাদের দেখাশোনা করতো এমন একজনের কাছ থেকে একটি মোবাইল চেয়ে নিতে সক্ষম হই। তখন বাবাকে কল দেই। মাত্র ১৭ সেকেন্ড কথা বলতে পেরেছি। আমার জায়গার নাম বলি বাবাকে এবং বলি কোনও দালালকে টাকা না দিয়ে অন্য কোনও পদ্ধতিতে ছাড়িয়ে নিতে।’

লিবিয়া গিয়ে যেভাবে মাফিয়াদের থেকে ছেলেকে উদ্ধার করলেন বাংলাদেশি নারী

মা শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলের কল পাওয়ার পর আমি আরও পাগলের মতো হয়ে যাই। তখন প্রতিজ্ঞা করি, মাফিয়াদের থেকে আমার ছেলেকে উদ্ধার করবো। তখন লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন বাঙালিকে আমার ছেলের বিষয়টি খুলে বলি। তাদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করি। দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তারা সব শুনে সাহায্য করেন। তখন সেখানে তাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আমার ছেলের ছবি এনে দেন। ছেলের এত খারাপ অবস্থা ছিল যে আমি ছবি দেখে ছেলেকেই চিনতে পারিনি। ছবিতে ছেলের অবস্থা দেখে চার দিন অসুস্থ ছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আইওএমের কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সহযোগিতায় ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে সেখানে বন্দি থাকা আরও ২৫০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। আমার ছেলে উদ্ধার হলেও তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। তারা আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। ছেলের কান্নার শব্দ শুনে আমিও কেঁদে ফেলি। তাকে একনজর দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। ছেলে তখন ত্রিপোলিতে ছিল, আর আমি বেনঘাজিতে।’ 

অদম্য সাহসী এই মা বলেন, ‘বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় গত ১০ মার্চ  আমার ছেলেকে দেশে পাঠানো হয়। আমিও তাদের সহযোগিতায় ১৬ মার্চ বাংলাদেশে এসে আমার ছেলের দেখা পাই। ঢাকা ক্যাম্পে এক সপ্তাহ থাকার পর কুমিল্লায় নিজ গ্রামে এসে তার চিকিৎসা করাই। এখনও সে মানসিকভাবে অসুস্থ। অনেক কিছু মনে রাখতে পারে না।’

মায়ের সাহসী ভূমিকা নিয়ে ছেলে ইয়াকুব বলেন, ‘আমি মনে করেছি আর মায়ের আর সঙ্গে দেখা হবে না। মা আমাকে আরেকবার জীবন দিয়েছেন। আমার মা পৃথিবীর সেরা মা। আমার মা আমাকে উদ্ধার করার জন্য টাকা ধার করে লিবিয়া যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি।’

প্রতিবেশী মহিন উদ্দিন বলেন, একজন নারী দেশ ছেড়ে লিবিয়া গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করা মোটেও সহজ কথা নয়। আমার কাছে এটা কাল্পনিক মনে হয়েছে। কিন্তু তিনি সেটা করেছেন। আবারও প্রমাণ হলো মায়ের ভালোবাসার কোনও তুলনা করা যায় না।’

শাহিনুর বেগম বলেন, ‘কোনও মায়ের সন্তান যেন অবৈধভাবে ইতালি না যায়। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ আমার ছেলের জন্য যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আমি আর তাকে বিদেশ পাঠাবো না। বাংলাদেশি কিছু দালাল আমার ছেলেকে খুঁজে দেওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমি তাদের নামে মামলা করবো। আমার কষ্টের টাকা ফেরত চাই। আমরা বর্তমানে ২০ লাখ টাকা ঋণে রয়েছি। আমার ঘরটি ছাড়া আর কিছু নেই। সবাই সহযোগিতা করলে ঋণের চিন্তা থেকে মুক্ত হবো।’

দেবিদ্বার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশিক উন নবী তালুকদার বলেন, ‘আমি ঘটনা শুনেছি। তাদের বিষয়ে খবর নিয়ে দেখি কী করা যায়। তবে কোনও সন্তানের প্রতি মায়ের এমন ভালোবাসা আসলেই বিস্ময়কর। আমি এই মাকে অবশ্যই দেখবো।’

Source link

Related posts

দুর্ভোগ কমছে না দৌলতদিয়ায়

News Desk

সাকিবের প্রচারণায় মাগুরায় তারকা ক্রিকেটারদের মেলা

News Desk

রাঙামাটিতে ২৫ গ্রামের মানুষ পানিবন্দি, পাহাড় ধসের শঙ্কা

News Desk

Leave a Comment