বলা হয় একশ বছর আগেও কুমিল্লায় রমরমা ছিল কামার শিল্প। এমনকি এক দশক আগেও এখানকার কামারপট্টিতে তৈরি জিনিসপত্রের কদর ছিল দেশজুড়ে। আগে প্রতিবারই কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে জেলার কামারপট্টিতে দাঁড়ানোর জায়গা মিলতো না। এখন সেখানকার কামাররা সময় পার করছেন চা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে!
কেউ কেউ কাজ করলেও পরিষ্কার বোঝা যায়, অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে এ ঐতিহ্য। কেউ কেউ বলছেন, আর কয়েক বছর পর এখানে কামারপাড়াই থাকবে না।
প্রায় শত বছর ধরে কুমিল্লার কামার শিল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে নগরীর চকবাজার কামারপট্টি। এই বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৩০টি দোকান এখনও বংশ পরম্পরায় ধরে রেখেছে এই শিল্পের বৈঠা।
৬৫ বছর এক দোকানে
ছয় দশক ধরে পারিবারিক ব্যবসা ধরে রেখেছেন বলাই কর্মকার (৭৪)। বাবা কালাচাঁন কর্মকারের হাত ধরে মাত্র ৯ বছর বয়সে কামারপট্টিতে ঢোকেন। ৬৫ বছর এক দোকানেই কেটেছে তার। দেখেছেন দা, ছুরি, ধামা, কুড়াল বানানোর সোনালী সময়। এখন দেখছেন খরা। দোকানে মন খারাপ করেই বসে থাকতে দেখা গেলো বলাইকে।
বলাই জানালেন, প্রথম দিকে চকবাজারের কেন্দ্রস্থলেই ছিল কামারপট্টি। তখন হাতেগোনা কয়েকটি দোকান ছিল। পরে কিছু বাড়লে পট্টিটাকে আমির দীঘির পাশে নিয়ে আসা হয়।ৱ
কয়েক বছর আগেও ছুরি-বটি কেনা, বানানো ও ধার দেওয়ার জন্য মানুষ লাইনে দাঁড়াতো। সকালে অর্ডার দিয়ে গেলে নিতে হতো পরদিন। একেক দোকানে কারিগর থাকতো ৮-১০ জন। কোরবানির ঈদ এলে দিন-রাত কাজ করেও কুল পেতেন না কামাররা।
‘বউ বাচ্চা নিয়ে ভালোই চলেছি একসময়। আমার সঙ্গের কারিগর ও দোকান মালিক অনেকের ঘরবাড়িও পাকা হয়েছে এ কাজ করে। ঘরে সব সময় ভালো খাবার ছিল। এখন আর সেদিন নেই। পেশাটাই যেন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিশোধ নিচ্ছে। দা, ছুরিই যেন আমাদের আয়-রোজগার কেটে নিয়ে গেছে।’ বললেন বলাই।
কর্মকার হানিফ মিয়া বলেন, লোহার দাম বেশি। প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়াতে হয়েছে। যেকারণে অনেকে স্টিলের জিনিসে ঝুঁকছেন। এখন দা-এর দাম ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা। আগে যা ছিল ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। ধামার দাম এখন সাইজ বুঝে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। বটনি দা ২৫০ থেকে ৮০০ টাকা। ছুরি ছোট-বড় ৫০ থেকে ২৫০ টাকা। আবার পশু জবাইয়ের বড় ছুরি ৫০০ টাকা বিক্রি করি। আগের চেয়ে ১০০ টাকা বেশি।
কামারপট্টিতে ভিড় নেই কেন
প্রবীণ কর্মকার হানিফ মিয়া বললেন, কামারপট্টি আগে জমজমাট ছিল। সারা বছর কাজ থাকতো। ঈদে রোজগারও ভালো হতো। এখন বিভিন্ন কোম্পানি স্টিলের জিনিস বাজারে এনেছে। সেগুলোর দাম আমাদের শ্রমের তুলনায় কম। সেগুলো রেডিমেড পাওয়া যায়। তাই মানুষ এখন আর আমাদের কাছে আসে না।
এখন আবার আধুনিক মেশিন দিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দা, ছুরি ধার দিয়ে আসে কিছু লোক। তাই একবার কিছু কিনলে আর আমাদের কাছে আসতে হয় না।
এছাড়া ভাঙা জাহাজের লোহার দাম বেড়েছে। যেকারণে অনেক ব্যবসায়ী পুঁজির অভাবে এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। কয়লার দামও দিগুণ। আগে ছিল সাত কেজি ৪০ টাকা এখন ৭০ টাকা। আমাদের কাজ অনুযায়ী দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি কয়লা লাগে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেলো, আগে কারিগরের বেতন ছিল দিনে ৩০০ টাকা। এখন তা বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে।
যেভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে
৬৫ বছর ব্যবসা করা বলাই কর্মকার বলেন এখনও এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, সরকার কত পদক্ষেপ নেয়। আমাদের জন্য কেউ কিছু করলো না। আমাদের পেটে ভাত ওঠে না। আমাদের বিনা সুদে ঋণ দিলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারতাম। শত বছরের একটা শিল্পও টিকে থাকতো।
বাবা রাখাল চন্দ্র কর্মকারের পর ২০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছেন ছেলে লিটন কর্মকার। তিনি বলেন, বিদেশি জিনিস অবাধে ঢুকছে। যে কারণে দেশি এ ঐতিহ্য হুমকির মুখে।
এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে প্রশাসনের কোনও উদ্যোগ আছে কিনা জানতে কথা হয় কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এটি দেশের প্রাচীন একটি শিল্প। কর্মকারদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নজর রয়েছে। আমরা পরিকল্পনা করছি কী করা যায়।