কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় ৪০ হাজার মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। একইসঙ্গে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এসব মানুষের দুঃখ দূর হয়েছে। এ জন্য আনন্দিত দ্বীপের বাসিন্দারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্ষার আগে বেড়িবাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় সাগরের জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাবেন শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দারা।
২০১২ সালের ২২ জুলাই সাগরের জোয়ারে টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ার বাঁধ ভেঙে মসজিদসহ কয়েকশ বসতভিটা সাগরে বিলীন হয়ে যায়। ভাঙন দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করে লোকালয় গ্রাস করেছিল। ফলে টেকনাফ উপজেলা থেকে দ্বীপে যাওয়ার একমাত্র সড়কটি ভেঙে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন দ্বীপবাসী।
এ ছাড়া জোয়ারের পানির কারণে লবণ মাঠ, ঘের, ফসলি জমি ও বসতভিটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এ কারণে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয় দ্বীপবাসী। প্রতিনিয়ত জোয়ারের তীব্র আক্রমণ তাড়া করে তাদের। তাই দ্বীপবাসীকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে বাঁধটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, শাহপরীর দ্বীপ প্রতিরক্ষা বাঁধ প্রকল্পের আওতায় তিন কিলোমিটার ভাঙনরোধে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে টেকসই বেড়িবাঁধ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসটিএ। দুই পাশের সিসি ব্লকের সাহায্যে বাঁধের শতভাগ কাজ চলতি বছরের এপ্রিলে শেষ হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শাহপরীর দ্বীপে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দ্বীপ রক্ষায় নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধের কাজ প্রায় শেষ। তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধের সাগর অংশে দুই স্তরের ব্লক বসানোর কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ঈদের আগে বেড়িবাঁধের কাজ শেষ করায় খুশি দ্বীপবাসী।
শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমে আরও এক কিলোমিটার পাড়া-মহল্লা ছিল। বেড়িবাঁধ ভেঙে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেছে আশপাশের এলাকা। এখানকার অনেক পরিবার দ্বীপ ছেড়ে টেকনাফ সদরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম এলে আমরা আতঙ্কে থাকি। এখন আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছি। বেড়িবাঁধ সংস্কার হওয়ায় এবার ঈদে আমরা খুবই আনন্দিত।’
দ্বীপের বাসিন্দা ও চাকরিজীবী হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বেড়িবাঁধ সংস্কার হওয়ায় দ্বীপের ৪০ হাজার মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন নিশ্চিত হয়েছে। মানুষের মনে স্বস্তি ফিরেছে। বিশেষ করে সরকার সাবরাংকে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন ঘোষণা করায় দ্বীপের মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ।’
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ায় দ্বীপের মানুষের ভিটেবাড়ির পাশাপাশি কৃষি, লবণ ও চিংড়ি ঘেরসহ নানা সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। তবে দ্বীপের দক্ষিণ পাশের কর্নারের বাঁধটি আরও টেকসই না করলে পুনরায় ভেঙে দ্বীপ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বাঁধের ওই অংশটিকে মজবুত করার দাবি জানাচ্ছি।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসটিএ গ্রুপের প্রতিনিধি উত্তম কুমার শাখারী (ননী) বলেন, ‘২০২১ সালে শাহপরীর দ্বীপ প্রতিরক্ষা বাঁধের সংস্কার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং পাউবোর তদারকিতে বাঁধের নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করেছি আমরা। চলতি মাসে নির্ধারিত সময়ে কাজটি শেষ করতে পেরেছি। কয়েকদিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপের তিন কিলোমিটার বাঁধের সংস্কারকাজ শেষ। একসময় শাহপরীর দ্বীপ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রতিরক্ষা বাঁধটি সংস্কার হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়েছে। আশা করছি, এ বছর বর্ষা মৌসুমে দ্বীপবাসী জোয়ার থেকে রক্ষা পাবেন।’
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের জুন মাসে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমের বেড়িবাঁধের একাংশ বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানিতে বিলীন হয়ে যায়। সংস্কারের অভাবে পরে ভাঙন আরও তীব্র হয়। প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ অরক্ষিত হয়ে শত শত পরিবারের ঘরবাড়ি সাগরে বিলীন হয়ে যায়।
দীর্ঘ ভোগান্তির পর ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ২.৬৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কারে প্রকল্প অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে দ্বীপে বসবাসকারী মানুষের বেঁচে থাকার আশা জাগে। বাঁধের কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘদিনের দুঃখ দূর হয় তাদের।