কক্সবাজারের টেকনাফে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর মূল হোতা টেকনাফ উপজেলার বিতর্কিত সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদকে (৬৭) গ্রেফতার করেছে র্যাব। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদককারবারি উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির সহযোগী। তার বিরুদ্ধে বেশ কটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলায় তিনি পলাতক রয়েছেন।
জাফর আহমদ টেকনাফের উত্তর লেঙ্গুর বিলের মিঠাপানিরছড়া মৃত সুলতান আহমদের ছেলে।
শুক্রবার রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল অ্যান্ড মিডিয়া) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার (১ নভেম্বর) রাতে ঢাকার পূর্ব বাসাবো এলাকার একটি বাসা থেকে জাফরকে আটক করা হয়। তিনি সীমান্তের শীর্ষ মাদককারবারি ছিলেন। তাকে টেকনাফ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।’
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টেকনাফে জাফরের নেতৃত্বে তার ছেলে দিদার মিয়া, শাহজাহান, ইলিয়াছ, রাশেদ ও সালাহ উদ্দিন প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় ও বিএনপি নেতাকর্মীদের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে। এতে বহু লোক আহত হয়। এই ঘটনায় জাফরের বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলা হলে তিনি তার ছেলেদের নিয়ে গাঢাকা দেন। এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকা থেকে তার ছেলে শাহজাহান মিয়াকে গ্রেফতার করে র্যাব।
র্যাব বলছে, ভয়ংকর মাদক ইয়াবা সিন্ডিকেটের টেকনাফের ডন মাদক সম্রাট আব্দুর রহমান বদি ওরফে ইয়াবা বদির বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিল সাবেক আলোচিত উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ ওরফে মাফিয়া জাফর। সংসদ সদস্য থাকাকালে আব্দুর রহমান বদি নিজের নির্বাচনি এলাকা টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। আর সেই স্বর্গরাজ্য কার্যক্রমের বিশ্বস্ত সহচর ছিল গ্রেফতারকৃত জাফর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১ হাজার ২৭৫ জন মাদক কারবারিকে তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে আব্দুর রহমান বদি ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর জাফরকে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ২০১৯ সালে আত্মসমর্পণকারী মাদক কারবারিরা পুনরায় জামিনে বের হয়ে জাফরের নেতৃত্বে আবার সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং ইয়াবা ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে।
জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিল গ্রামের বাসিন্দা সুলতান আহমেদের ছেলে জাফর প্রথম জীবনে ছিলেন পান বাজারের শ্রমিক। সেখান থেকে হয়ে উঠেন শ্রমিকনেতা নামধারী দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ।
টেকনাফ স্থলবন্দরের সব বাণিজ্যিক ট্রাককে কেন্দ্র করে রমরমা চাঁদাবাজি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা জাফর অবৈধ টাকা ও চিহ্নিত কয়েকজন ডাকাতদের ক্ষমতার জোরে একসময় নির্বাচিত হন ইউপি সদস্য। পরে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় দফায় ইউপি চেয়ারম্যান হয়ে যান তিনি। সময়ের পরিক্রমায় নানা রূপে আবির্ভূত হয়ে শুধুই বেড়েছে জাফরের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আর অবৈধ অর্থ। ওয়ান ইলেভেনের সময় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকাকালে বদির সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্যতা। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে শুরু হয় জাফরের নতুন অধ্যায়।
ক্ষমতার পালা বদলের পর ২০০৯ সালে বিএনপি ছেড়ে সাবেক এমপি বদির হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জাফর। বদির ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ছেলেদের দিয়ে মাদকের সম্রাজ্য গড়ে তোলেন তিনি। ফলে নাম উঠে আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মাদক তালিকায় শীর্ষ দশে। বদির বদান্যতায় কালো টাকার জোরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়ে দলটির সমর্থন ও বদির ছত্রছায়ায় চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার উপজেলা চেয়ারম্যান হন। পঞ্চম উপজেলা নির্বাচনে একইভাবে পদ ধরে রাখেন। বদির একছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ষষ্ট উপজেলা নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। প্রকাশ রয়েছে তিনটি উপজেলা নির্বাচনে তিনি অন্তত শত কোটি খরচ করেছেন। গত সংসদ নির্বাচনে উখিয়া টেকনাফ আসনে নৌকার পক্ষে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভোট ডাকাতি করে বদির গভীর আস্থা অর্জন করে ‘বদির সেনাপতি’ তকমা পেয়ে যান।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন,‘আটক শীর্ষ মাদক কারবারি জাফরের বিরুদ্ধে থানায় মামলা রয়েছে। শনিবার সকালে কারাগারে পাঠানো হবে এবং তাকে রিমান্ড চাওয়া হবে।’
এদিকে, প্রথম মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের দ্বায়ে ২০১৯ জাফর ও তার স্ত্রী খাদিজার নামে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুদক। স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলার অগ্রগতির বিষয়টি জানা না গেলেও চলতি বছর মে মাসে জাফরের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সংস্থাটি।