শেরপুরে বৃষ্টি না হওয়ায় ও প্রধান নদ-নদীর পানি কমা অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে রয়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষ। পানি নেমে গিয়ে এবার ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষজন বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ বছর শেরপুরে ৩৩ হাজার ১৭৯টি পুকুরে মাছ চাষ করছেন ১৮ হাজার ১৩৫ জন চাষি। এর মধ্যে বন্যায় ভেসে গেছে ৭ হাজার ৩০০ পুকুরের প্রায় শত কোটি টাকার মাছ।
নালিতাবাড়ী উপজেলার পাঁচগাও এলাকার মৎস্যচাষি আমিন মোহাম্মদ বলেন, ‘পুকুর থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। চারপাশে নেট লাগিয়েছিলাম। কিন্তু কাজ হয়নি। ব্যাংকলোনসহ কৃষি প্রণোদনা দরকার। তা না হলে আর মাছ চাষ করা সম্ভব নয়।’
শেরপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা প্রণব কুমার কর্মকার বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে আমরা এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এদিকে বন্যায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা। মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় শত কোটি টাকা। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলার ৪৭ হাজার হেক্টর আবাদি জমির আমন ধান ঢলের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার হেক্টর জমির সবজি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার কমপক্ষে পৌনে দুই লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সদর উপজেলার তারাগড় গাঙপাড় গ্রামের কৃষক লিয়াকত উল্লাহ বলেন, ‘আমার দুই একর জমি আবাদ করছিলাম, তা বন্যায় ডুইবা গেছে। অহন কি কইরা খামু?’
সদর উপজেলার ধলা ইউনিয়নের তারাগড় গাঙপাড় গ্রামের খামারি স্বর্ণ মিয়া বলেন, ‘মুরগির খামার দিছিলাম ৬০০ মুরগি আছিল। বন্যার কারণে অর্ধেক মইরা গেছে। বাকি অর্ধেক অন্যখানে টান (শুকনো) জায়গায় নিয়া রাখছি। মাত্র ১৫ দিন আগে ১ লাখ ২৫ হাজার টেহা দিয়া একটা গরু কিনছিলাম। বন্যার পানি উঠায় কোনোখানে রাহার জায়গা না পাওয়ায় পানিতে দাঁড়াইয়া থাকতে থাকতে গরুডা মইরা গেছে। পরে মরা গরু পুইত্তা থওয়ার জায়গা না পাইয়া পোলা আর আমি ওই মরা গরু নিয়ে বন্যার পানিতে ভাসাই দিছি।’
জেলা খামারবাড়ির উপপরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, ‘অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চলতি মৌসুমে সাড়ে ৯৩ হাজার হেক্টর আমনের জমিতে ৪৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবজি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার হেক্টর। সব মিলিয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বন্যার পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ সম্ভব হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরি করে তাদের সার-বীজ দেওয়া হবে। এ ছাড়া কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে।’
পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লাবিত অধিকাংশ এলাকার বিধ্বস্ত রূপ ভেসে উঠছে। পানি কমলেও বন্যাদুর্গত এলাকায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। এলাকাগুলোর বেশির ভাগ সড়ক ভেঙে গেছে। দুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির সংকট। গৃহপালিত গরু-মহিষসহ গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষ।
সবজিখেতসহ মাঠ ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে ঘাসের অভাব। এ ছাড়া বাড়িঘরে পানি ওঠায় নষ্ট হয়ে গেছে খড়ের গাদা। ফলে একদিকে খাদ্যসংকট, অন্যদিকে মাথার ওপর চাল না থাকায় বহু মানুষ চরম কষ্টে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
ঝিনাইগাতী উপজেলার নলকুড়া ইউনিয়নের কুশাইকুড়া গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এমনভাবে সব কিছু তছনছ হয়েছে তা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। ঢলের পানির তাণ্ডবে আমাদের বাড়িভিটায় ২০-২৫ ফুট গর্ত হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ঘরের কোনোকিছু বের করতে পারি নাই। এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে জীবনটা রক্ষা করেছি। পানি নেমে যাওয়ার পর শুধু কয়েক ফর্দ টিন ও কিছু জিনিসপত্র পেয়েছি। আসবাবপত্র-টাকাপয়সা, ধানচাল যা ছিল সবই ভেসে গেছে।’
নিরুপায় হয়ে নলকুড়ায় নানার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এই বন্যাদুর্গত আরও বলেন, ‘আমাদের বাড়িতে আমার বাবা আব্দুল মালেকের ১টি আধা পাকাঘরসহ টিনশেড সাতটি ঘর, আমার চাচা আব্দুল কাদিরের দুটি এবং চাচাতো ভাই শাহজাদার একটি ঘর পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ভেসে গেছে। প্রায় ৩ একর জমির ধান সবই ঢলের পানিতে আসা বালুর নিচে চাপা পড়েছে।’
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নকিবুজ্জামান খান বলেন, ‘জেলার পাহাড়ি নদী মহারশি, সোমেশ্বরী, ভোগাই ও চেল্লাখালীর পানি বিপদসীমার অনেক নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।’
তিনি জানান, বুধবার (৯ অক্টোবর) সকালে নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর পানি কমে নালিতাবাড়ী পয়েন্টে বিপদসীমার ১৮৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং নাকুগাঁও পয়েন্টে ৩৬০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চেল্লাখালী নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়লেও তা বিপদসীমার ৫২১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যায় ৫ দিনে ১১ জনের মৃত্যু
এদিকে নালিতাবাড়ী উপজেলায় সোমবার বন্যার পানিতে ডুবে জিমি আক্তার নামে ৮ বছরের এক শিশু মারা গেছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছানোয়ার হোসেন। এ ছাড়া নকলা উপজেলার টালকি এলাকায় রাহিম নামে ৫ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন নকলা থানার ওসি হাবিবুর রহমান। এ নিয়ে গত ৫ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
তবে বন্যায় মৃতের সংখ্যা মোট ৮ জন বলে জানিয়েছেন শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নকলায় পানি বেড়েছিল তা কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে।’
পানি পুরোপুরি সরে যাওয়ার পর কৃষি, মৎস্য ও ঘরবাড়িসহ ক্ষয়ক্ষতি কোন সেক্টরে কেমন হয়েছে, তা জানার পর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
তিনি আরও বলেন, ‘আপাতত বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে টেউ টিন ও নগদ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ তৎপরতা পুরোদমে চলছে। জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।’