শেরপুরে বন্যায় বিধ্বস্ত সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি, দিশেহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ
বাংলাদেশ

শেরপুরে বন্যায় বিধ্বস্ত সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি, দিশেহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ

টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় শেরপুরের নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে হাজারো পরিবার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাটির ঘরে থাকা পরিবারগুলো। প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করাসহ টিন ও অর্থ বরাদ্দ চেয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে দ্রুত সেগুলো বিতরণ করা হবে।

৪ অক্টোবর ভোর থেকে স্মরণকালের ভয়াবহ এক পাহাড়ি ঢল দেখেছে শেরপুরবাসী। স্থানীয়দের দাবি, প্রতিবছর বর্ষায় দুই–তিনবার ঢলে ভাসলেও এর আগে এমন তাণ্ডবলীলা কেউ দেখেননি আগে। কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল চারটি নদীপাড়ের মানুষের সব লন্ডভন্ড করে দেয়। গত তিন দিন বৃষ্টি না থাকায় ও উজানের পানি কমতেই ভেসে উঠছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।

জেলার অন্য তিন উপজেলা বাদে কেবলমাত্র ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলাতেই পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত কিংবা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় শেরপুর জেলায় পাঁচ দিনে নারী ও শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আরও প্রায় দুই শতাধিক।

এখনও অনেক নিচু এলাকার মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। বন্যার পানি নিচে এখনও বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষেতের রোপা আমন ধান তলিয়ে রয়েছে। বন্যাকবলিত অধিকাংশ স্থানে রোপা আমন ধান একেবারে নষ্ট হওয়ায় এক মুঠো ধানও পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারগুলো চিন্তায় পড়েছেন। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় এবং কাদায় পানিতে একাকার হয়ে থাকায় মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। পুকুর ও মাছের খামারগুলো থেকে সব মাছ ভেসে যাওয়ায় জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষীদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এ ক্ষতি তারা কীভাবে পূরণ করবেন তা ভেবে কোন কূল পাচ্ছেন না।

এ বন্যায় জেলার ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সাড়ে ছয় হাজার মাটির কাঁচা, আধা পাকা ও পাকা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। ঢলের স্রোতে যা যা পড়েছে সব মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সঙ্গে, নয়তো নিয়ে গেছে ভাসিয়ে। সব হারিয়ে দিশেহারা এসব পরিবারগুলো। পানি কমায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ ঘরে ফিরছেন মানুষ, ভেঙে যাওয়া ঘর থেকে প্রয়োজনীয় আসবাব উদ্ধারের চেষ্টা করছেন তারা।

ঝিনাইগাতী উপজেলার ব্রিজপাড় এলাকার বাসিন্দা রাশেদা বেগম বলেন, ‘ঢলে আমার তিনটা ঘর ভেঙে গেছে। আমি গরিব মানুষ। এখন কীভাবে এই ঘর ঠিক করমু, চিন্তা করে কূল পাইতাছি না।’

শেরপুরে বন্যায় বিধ্বস্ত সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি, দিশেহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ

‘ঢলের দিন আমার ছোট মেয়েটাকে কোনোরকমে ঘাড়ে নিয়ে ঘরের খুঁটি ধইরা গলা সমান পানিতে সারা রাত দাঁড়ায়া ছিলাম। মনে করছিলাম নিজেও বাঁচমু না, আর মাইয়াটারেও বাঁচাতে পারমু না। চোখের সামনে ঘরের সব জিনিস ভাসায়া নিয়ে গেছে, কিচ্ছু বাঁচাইতে পারি নাই। অটো চালায়া সংসার চালাইতাম, সেইটাও নষ্ট হয়ে গেছে গা। এহন কী যে করমু বুঝতাছি না।’ ছলছলে চোখে কথাগুলো বলেন নালিতাবাড়ী উপজেলার খলিশাকুড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম।

একই এলাকার বাসিন্দা নাকুগাঁও স্থলবন্দরের শ্রমিক চিন্তাহরণ বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ দিন আইনা দিন খাই। আমার তিনটা ঘর ঢলে ভাইঙ্গা নিয়ে গেছে গা। ঘরের ধান-চাল সবই ভাসায়া নিয়ে গেছে গা। এখন কি খায়া বাঁচমু? সরকার আমগরে সাহায্য না করলে আর কোনও উপায় নাই।’ 

আরেক বাসিন্দা জুলহাস বলেন, ‘ঢলের পানিতে হাঁস, মুরগিসহ ঘরের সব ভাসায়া নিয়ে গেছে গা। ছোট ছোট পুলাপান নিয়া কোনোমতে জীবন বাঁচাইছি।’

তাদের মতো এমন অসহায়ত্বের গল্প দুই উপজেলার হাজার হাজার মানুষের। দিন এনে দিন খাওয়া এসব দরিদ্র মানুষ তাদের পেটের ক্ষুধার চেয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে বেশি চিন্তিত। প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে পুনর্বাসনে সহায়তা করা হবে।

শেরপুরে বন্যায় বিধ্বস্ত সাড়ে ৬ হাজার ঘরবাড়ি, দিশেহারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ

ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আশরাফুল আলম রাসেল জানান, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে এ উপজেলায় ৫০০ ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং এক হাজারের মতো ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের সহায়তা করা হবে। 

নালিতাবাড়ীর ইউএনও মাসুদ রানা বলেন, ‘এ উপজেলায় চার হাজার ৬৮টি ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও প্রায় এক হাজার ২০০ ঘর আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির তালিকা তৈরির কাজ চলছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে টিন ও নগদ অর্থ বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে।

Source link

Related posts

পুলিশের সাঁজোয়া যান সাজছে রণসাজে

News Desk

শেষ মুহূর্তে জমজমাট খুলনার পশুর হাট

News Desk

মগবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত বেড়ে ৭

News Desk

Leave a Comment