শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝিতেও খুলনা অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টি নেই। এদিকে আমন চাষের মৌসুম চলছে। বৃষ্টি না হওয়ায় পানি সংকটে কৃষকদের মাঝে হাহাকার দেখা দিয়েছে। উপায় না পেয়ে অনেকে শ্যালো মেশিন, কেউবা বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহার করে সেচ দিয়ে আমন রোপণ করছেন।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ২০২১ সালের জুলাইয়ে গড় বৃষ্টিপাত ছিল ৩৫৫ দশমিক ৫৮ মিলিমিটার। চলতি বছরের জুলাইয়ের ২৫ জুলাই পর্যন্ত গড় বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ৯৯ দশমিক ৭৮ মিলিমিটার, যা বিগত বছরের চেয়ে ২৫৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার কম।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, খুলনা অঞ্চলের অধিভুক্ত চারটি জেলা রয়েছে। জেলার আওতায় রয়েছে মেট্রো দৌলতপুর, মেট্রো লবণচরাসহ রূপসা, বটিয়াঘাটা, দিঘলিয়া, ফুলতলা, ডুমুরিয়া, তেরখাদা, দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা। বাগেরহাট জেলার আওতায় রয়েছে বাগেরহাট সদর, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, রামপাল, কচুয়া, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও চিতলমারী উপজেলা। সাতক্ষীরা জেলার আওতায় রয়েছে সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, তালা, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলা এবং নড়াইল জেলার আওতায় রয়েছে নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলা। এই চারটি জেলার মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ পাঁচ লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ হেক্টর। এর মধ্যে খুলনা জেলার মেট্রোসহ বাকি উপজেলাগুলোতে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এক লাখ ৫৩ হাজার ৯৮১ হেক্টর, বাগেরহাটের উপজেলাগুলোতে এক লাখ ২২ হাজার ২৩১ হেক্টর জমি, সাতক্ষীরার উপজেলাগুলোতে এক লাখ ৬৫ হাজার ৮৭২ হেক্টর ও নড়াইলের উপজেলাগুলোতে ৭৮ হাজার ৫৪৯ হেক্টর।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চলের চার জেলার রোপা আমন (হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের) বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ১৭ হাজার ৩৫২ হেক্টর। গত ২৫ জুলাই পর্যন্ত রোপা আমনের বীজতলার অগ্রগতি হয়েছে ৯ হাজার ৮৩৬ হেক্টর, যার হার ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
অপরদিকে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চলের চার জেলার রোপা আমন (হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের) আবাদ লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৯৯ হাজার ১১০ হেক্টর। ২৫ জুলাই পর্যন্ত রোপা আমন আবাদের অগ্রগতি ৬ হাজার ৬২৮ হেক্টর, যার হার ২ দশমিক ২ শতাংশ।
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি না থাকায় বেশিরভাগ জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে। কৃষকদের আমন বীজতলা রোদে হলুদ বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। তাই বিকল্প হিসেবে নালা-ডোবার বাঁধের পানি, বোরিং (সেচের) পানির মাধ্যমে বীজতলাসহ অনাবাদি জমি চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। বৃষ্টির মাধ্যমেই শঙ্কা কাটতে পারে বলে জানান একাধিক কৃষক।
দিঘলিয়ার কৃষক আজমল হোসেন বলেন, ‘সাধারণত আষাঢ় থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত আমন ধানের চারা রোপণ করা হয়। কিন্তু এবার তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় আমন চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি।’
কৃষক ফরহাদ মিয়া বলেন, ‘বীজতলায় তৈরি হওয়া চারা ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে জমিতে লাগানো হয়। কিন্তু অনেক কৃষকের চারার নির্দিষ্ট বয়স পার হয়ে গেলেও পানির অভাবে জমিতে রোপণ করতে পারিনি।’
গাজীরহাটের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতি বছরই জুনের প্রথম থেকে বর্ষা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, ১৫ জুনের পর হতে পুরোপুরি বর্ষা শুরু হয়। তবে এবার জুন পেরিয়ে জুলাই মাসও চলে যাচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। পানির অভাবে কৃষকরা জমিতে চারা লাগাতে পারছে না।’
কালিয়ার কৃষক তৈয়েবুর কাজী বলেন, ‘প্রতি বছর এই সময় প্রচুর বৃষ্টি হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর বৃষ্টির দেখা নেই। ইতোমধ্যে পাঁচ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষের জন্য বীজতলা প্রস্তুত করেছি। বৃষ্টি নেই, তাই সেচের মাধ্যমে চারা প্রস্তত করা হয়েছে। বৃষ্টির না হওয়ায় চাষে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। বোরিং হতে পানি নিতে তেল, পাইপ ও শ্রমকি খরচ লাগবে, যা বৃষ্টি হলে লাগতো না।’
কালিয়ার ধুশোআটি ও বিলবাউট ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি না হওয়ায় অনেক কৃষক আমন চাষে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে। সেচের মাধ্যমে চাষ করতে গেলে প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। আমন চাষে সাফল্যের মুখ দেখতে হলে বৃষ্টির বিকল্প কিছুই নেই।
খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ জানান, পরিমিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত বছরের তুলনায় লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কম হয়েছে। বীজতলা প্রস্তুত হয়েছে একটু কম। যেহেতু বৃষ্টিপাত কম, সেক্ষেত্রে কৃষকদের আমরা সম্পূরক সেচ দিয়ে বীজতলা প্রস্তুতের জন্য নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়েছি। এখনও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে, তাই বীজতলা প্রস্তুত থাকলে আর পরিমিত বর্ষার দেখা মিললে আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুল হক জানান, এবার আমন চাষ কিছুটা বিলম্বিত হতে পারে। বৃষ্টির না হওয়ায় অনেক কৃষকই হতাশ হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টি না হওয়াতে আমন চাষে নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা। তবে এখনও বৃষ্টিপাতের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।